সম্পাদক সমীপেষু...
কী উত্তর দেব
‘বিতর্কিত বই সরিয়ে নেবেন প্রকাশকরাই’ শীর্ষক সংবাদের (১২-২) পরিপ্রেক্ষিতে এই পত্র। ভারতবিদ ওয়েন্ডি ডোনিগারের (ছবি) ‘দ্য হিন্দুজ: অ্যান অল্টারনেটিভ হিস্ট্রি’ বইটির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে ‘শিক্ষা বাঁচাও আন্দোলন কমিটি’ গোটা বিশ্বের কাছে যে-বার্তা পাঠালেন, তা চিন্তা করে শিউরে উঠছি। প্রসঙ্গক্রমে জানাই, আমি বইটির লেখিকা ডোনিগারের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় রত। সেখানে আমার পড়ানোর অন্যতম বিষয় ‘ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতি’। ভাবছি, এর পর কী উত্তর দেব, ক্লাসে ছাত্রছাত্রীরা যখন প্রশ্ন তুলবে, ‘ভারতবর্ষও কি পৃথিবীর অন্য বহু দেশের মতো মৌলবাদের পথেই হাঁটছে? সেখানে বাক্স্বাধীনতা কি কমছে?’ মনে প্রশ্ন জাগছে, উক্ত কমিটির সাধের হিন্দুধর্ম কি এতই ঠুনকো যে ডোনিগার কী লিখলেন, তাতে হিন্দুধর্মের গায়ে কাদা লেগে যাবে বা হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে ডোনিগারের ব্যাখ্যাই মানুষের মনে বদ্ধমূল হবে?
গবেষণামূলক চিন্তার ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যে সর্বদাই একাধিক পরস্পরবিরোধী মতের অস্তিত্ব থাকে। সে-সব নিয়ে আলোচনা হয়, প্রবল তর্ক হয়, উত্তপ্ত বাক্য-বিনিময় হয়। কিন্তু অন্তত শিক্ষাক্ষেত্রে বিরোধী মতের প্রকাশ্য কণ্ঠরোধ কখনওই ঘটে না। ভাগ্যিস ঘটে না! নচেৎ বিতর্কিত বিষয় পঠনপাঠনের কারণে এই পত্রলেখককে কত বার যে ঘেরাও হতে হত তার ইয়ত্তা নেই। বিদেশি নাগরিকের এমন স্পর্ধার কারণে তাকে সে-দেশ থেকে বহিষ্কারের দাবিও উঠত হয়তো।
একটি উদাহরণ দিই। পরিবেশের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বিষয়ক পরিবেশবিদ্যার এক ক্লাসে মার্কিন ঐতিহাসিক লিন হোয়াইট-এর লেখা, ১৯৬৭ সালে ‘সায়েন্স’ পত্রিকায় প্রকাশিত একদা আলোড়ন সৃষ্টিকারী নিবন্ধ ‘দ্য হিস্টোরিকাল রুটস অব আওয়ার ইকলজিকাল ক্রাইসিস’ নিয়ে বিশদ আলোচনা করতে হয়। হোয়াইটের বক্তব্য: খ্রিস্টধর্মের অন্তর্নিহিত ধারণা হল, মানুষের ভোগের জন্য ঈশ্বর প্রকৃতিকে সৃষ্টি করেছেন। এই ভোগবাদী মূল্যবোধই শিল্প-বিপ্লবোত্তর কালে উন্নত প্রযুক্তিতে দক্ষ পাশ্চাত্যের মানুষকে প্রকৃতি লুণ্ঠনে নৈতিক সমর্থন দিয়েছে। তারই পরিণতি আজকের পরিবেশ সংকট। প্রবন্ধটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে দেশের ধার্মিক খ্রিস্টানরা হোয়াইটের মুণ্ডপাত করল তাঁকে ‘নাস্তিক কমিউনিস্ট’ বলে। সন্দেহ প্রকাশ করল যে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের চর। কিন্তু এই প্রবন্ধ প্রকাশের জন্য ‘সায়েন্স’ পত্রিকার ওই সংখ্যাটি তুলে নেবার দাবিতে আন্দোলন হয়েছে বলে শুনিনি। ক্লাসে হোয়াইটের বক্তব্য পেশ করে অবধারিত ভাবে যে আলোচনায় আমাকে যেতে হয়, তা হল, তুলনামূলক ভাবে কেন হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও আমেরিকার আদি জনজাতির ধর্ম অনেক বেশি প্রকৃতিদরদি। গত দুই দশকে কখনও কারও কটূক্তি শুনতে হয়নি।
মজার কথা, উক্ত আন্দোলন কমিটি কিন্তু ডোনিগারের বইটির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে এর বক্তব্য নিয়ে চর্চা বাড়িয়ে দিলেন। যেহেতু সাম্প্রতিক এবং প্রবল ভাবে বিতর্কিত, সেহেতু আমার মতো অনেকেই পুরো বইটি অথবা এর অংশবিশেষ ক্লাসে পাঠ্য করবেন। তার মানে এই নয় যে, ডোনিগারের সব বক্তব্য মেনে নেওয়া হবে। যা হবে, তা হল, ক্লাসে সেই বক্তব্য নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলবে। একদা রুশদির ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ বিতর্কিত হয়েই বহুল পঠিত ও চর্চিত হয়েছিল।
ডোনিগার হিন্দুধর্ম ও সমাজ বিষয়ে প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে এক নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি কী লিখেছেন, কেন লিখেছেন সে আলোচনার ক্ষেত্র এটা নয়। মোটের উপর পণ্ডিতদের অনেকেই মনে করেন না যে লেখিকা তাঁর তত্ত্বপ্রমাণে সফল, যদিও তাঁর কিছু বক্তব্য ভেবে দেখার মতো। কিন্তু লেখিকার বক্তব্যে যদি কারও ধর্মবিশ্বাসে আঘাত লাগে এবং ফলস্বরূপ সংবিধানের ২৯৫এ ধারা অনুযায়ী মামলা রুজু করা হয়, তা হলে দুশ্চিন্তার কারণ ঘটে বইকী। এ কোন তালিবান জমানার দিকে চলেছি! আমাদের সৌভাগ্য ১৮৬১ সালে এই আইন ছিল না। থাকলে ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যকেও বাজারছাড়া হতে হত। মাইকেল তো সে দিন স্রোতের বিপরীতে হেঁটে রামায়ণের এক অংশের নতুন নির্মাণ ঘটিয়েছিলেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.