ব্যাঙের মতোই জলে থাকে চাইবাসার দুই ভাই!
তাঁতনগর মহকুমার পাঁচ বছরের রোহিত আর বছর তিনেকের মঙ্গল। দিনে ১২-১৪ ঘণ্টা জলের গামলায় বসে থাকে দু’জনে। রাতে ঘুমোনোর সময় তাদের গায়ে দেওয়া হয় ভেজানো কম্বল। গরম, বর্ষা, কনকনে ঠান্ডাতেও জল ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারে না তারা। শরীর জলে না-ভিজলে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।
অনেকটা যেন রূপকথার ‘উভচর-মানুষ’ দু’জনেই। বাস্তবটা কিন্তু একেবারেই অন্য রকম। |
তাঁতনগরের ডোবরোবাসার বাসিন্দা মাধব সোয়। ওড়িশায় দিনমজুরের কাজ করেন। স্ত্রী নাগুরি গৃহবধূ। দরিদ্র পরিবার। ওই দম্পতিরই ছেলে রোহিত, মঙ্গল। জন্মের পর থেকেই শরীর খারাপ থাকত দু’টি শিশুর। দিনভর কান্নাকাটি। নাগুরি জানান, অন্যদের মতো তাঁরা ভেবেছিলেন বাচ্চা তো কাঁদবেই। কিন্তু একদিন দেখেন, আচমকা গায়ে জল পড়তেই কান্না থামায় রোহিত। এর পর থেকে কাঁদলেই বড় ছেলের গায়ে জল ছিটিয়ে দিতেন মা-বাবা, আত্মীয়রা। জন্মের পর ছোট ছেলে মঙ্গলের কান্না এ ভাবেই থামাতেন তাঁরা। নিরক্ষর গরিব গ্রামের কেউ-ই তার কারণ খোঁজার চেষ্টা করেননি। দুই ছেলেকে শান্ত করতে বাড়ির উঠোনে জলভরা গামলায় বসিয়ে রাখা রাখতেন সকলে। খেলাধুলো করলেও কিছু ক্ষণ পর পরই শরীর চাঙ্গা করতে জলে গলা ডুবিয়ে বসে থাকে রোহিত, মঙ্গল।
খবর পেয়ে ওই পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্থানীয় প্রশাসন। ছেলে দু’টিকে বড় হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করানোর উদ্যোগী হন পশ্চিম সিংভূমের মাঝগাঁওয়ের বিধায়ক বরকূঁয়র গগরাই। আজ রাঁচির রাজেন্দ্র ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্স-এ (রিমস) নিয়ে আসা হয় রোহিতদের।
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ‘এক্টোডারমাল ডিসপ্লেসিয়া’ নামে অত্যন্ত বিরল রোগে আক্রান্ত দু’টি শিশু। এখনও পর্যন্ত গোটা বিশ্বে মাত্র ৭ হাজার মানুষ ওই রোগের শিকার হয়েছেন। চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী, প্রতি আড়াই লক্ষ মানুষের মধ্যে এক জন ওই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। বংশ পরম্পরার তা ছড়িয়ে যায়। রোহিতদের মা-বাবার মধ্যে এক জন রোগটির ‘বাহক’ বলে জানান চিকিৎসকেরা।
কলকাতার ‘ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেল্থ’-এর অধিকর্তা অপূর্ব ঘোষ বলেন, “অসুখটা জন্মগত। মূলত মহিলারই রোগটির বাহক হন। তবে, বেশি আক্রান্ত হয় ছেলেরাই।”
রোগটির সমস্যা কী? চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, রোহিতদের শরীরে কোনও ঘর্মগ্রন্থি নেই। তা-ই দেহের অভ্যন্তরীণ তাপ বাইরে বের হতে পারে না। শরীর অত্যধিক গরম হয়ে যাওয়ায় অস্বস্তি হতে থাকে। জলের সংস্পর্শে থাকলে তা-ই রোগী আরাম পায়। এই রোগে আক্রান্ত কারও জ্বর হলে তা প্রাণঘাতীও হতে পারে। জিন-বাহিত এই রোগে আক্রান্তদের মাথায় চুল, দাঁত, নখকিছুই থাকে না। তবে, নাগুরির বড় ছেলে রোহিতের একটি দাঁত রয়েছে।
রিমসের শিশু বিভাগের প্রধান অরুণকুমার শর্মা জানান, হাসপাতালে আপাতত দু’টি বাচ্চার গায়ে মলম লাগিয়ে রাখা হয়েছে। তাতে ত্বক শুকিয়ে যেতে পারবে না। কষ্টও হবে না তাদের। এই রোগ সারাতে তেমন কোনও ওষুধ এখনও তৈরি হয়নি। দু’টি শিশুর চামড়ার পরীক্ষা করানো হবে।
সব জেনে নাগুরি বলছেন, “চিকিৎসা করানোর টাকা আমাদের কাছে নেই। ভগবান দু’জনকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। ওদের উনি যে রকম তৈরি করেছেন, তেমনই থাকুক।” |