|
|
|
|
পাশে বিজেপি, তেলঙ্গানা বিল পাশ হল লোকসভায় |
শঙ্খদীপ দাস • নয়াদিল্লি
১৮ ফেব্রুয়ারি |
সংসদ চত্বর জুড়ে অভূতপূর্ব নিরাপত্তা, লোকসভা টিভিতে বন্ধ সরাসরি সম্প্রচার, সভাকক্ষের মধ্যে সরকারপক্ষের শীর্ষ নেতাদের ঘিরে জনাকয়েক সাংসদের সুরক্ষাবলয়, স্লোগান-পাল্টা স্লোগান বাদ গেল না কিছুই। আর এমন নাটকীয় পরিস্থিতির মধ্যেই অবশেষে আজ ধ্বনি ভোটে লোকসভায় পাশ হয়ে গেল অন্ধ্রপ্রদেশ পুনর্গঠন বিল। যে বিল পাশ হওয়ার অর্থ একটাই। দেশের ২৯ তম রাজ্য ‘তেলঙ্গানা’ গঠনে বাকি রইল মাত্র একটিই ধাপ। কাল বিলটি রাজ্যসভায় পাশ হলেই চূড়ান্ত স্বীকৃতি পাবে পৃথক রাজ্য গঠনের দাবিতে দীর্ঘ ষাট বছরের আন্দোলন ও আবেগ। যার আগাম সম্ভাবনা ধরে নিয়ে আজ পর্যন্ত অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশে বিকেল থেকে উঠে এলো দুই বিপরীত ছবি। আবির মেখে বিজয় উল্লাস শুরু হল তেলঙ্গানায়। চরম বিক্ষোভের হুঁশিয়ারি দিয়ে বন্ধ ঘোষণা হল সীমান্ধ্রে। |
|
তেলঙ্গানা বিল পাশের আনন্দে। হায়দরাবাদে মঙ্গলবার। ছবি: পিটিআই। |
বস্তুত অন্ধ্র ভাগ নিয়ে এই বিপরীত আবেগের কেন্দ্রে রইল রাজনীতিই। সামনেই লোকসভা ভোট। যে লড়াইয়ে এ বার জাতীয় স্তরে অস্তিত্ব রক্ষার চ্যালেঞ্জ কংগ্রেসের সামনে। সে জন্য অন্ধ্রপ্রদেশ পুনর্গঠন বিল পাশ করাতে মরিয়া ছিলেন সনিয়া গাঁধী। আর অপ্রত্যাশিত ভাবে এই বিলের সমর্থনে কংগ্রেসের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল বিজেপি! বিভিন্ন সময় তেলঙ্গানা বিল পাশে বাধা দিচ্ছিলেন যে সুষমা স্বরাজ এবং লালকৃষ্ণ আডবাণী, তাঁরাই আজ একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গেলেন! এমনকী তৃণমূল বা বামেরা বিলে সংশোধনী আনলেও তাতে সায় দিল না বিজেপি। বরং রাজনৈতিক কৃতিত্বের ভাগ চেয়ে সুষমা আজ বলেন, “শুধু সনিয়া আম্মার ধন্য ধন্য করলে চলবে না! তেলঙ্গানাবাসীরা এই চেন্নাম্মাকেও (ছোট মা) কিন্তু মনে রাখবেন।” |
সবিস্তারে...
|
সন্দেহ নেই, বিজেপি সমর্থন না করলে অন্ধ্রপ্রদেশ পুনর্গঠন বিল পাশ করানো সহজ ছিল না। তার পরেও লোকসভায় বিলটি পাশের পরেই সনিয়া-রাহুলকে কৃতিত্ব দিতে মাঠে নেমে পড়েন কংগ্রেস নেতারা। তাঁদের বক্তব্য, দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেওয়ার নজির রাখলেন সনিয়া। কারণ, এ ব্যাপারে সব চেয়ে বড় ধর্মসঙ্কট ছিল তাঁরই। তেলঙ্গানার আবেগ রাখবেন না সীমান্ধ্রের? সনিয়া বুঝতে পারছিলেন, দু’দিক রক্ষা করতে গেলে কোনওটিই থাকবে না। যে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে গত দুই লোকসভা ভোটে তিরিশটিরও বেশি আসন পেয়েছে কংগ্রেস, সেখানে জগন্মোহন রেড্ডির দাপটে সনিয়ার দল এখন কার্যত কোণঠাসা। তবু তেলঙ্গানা গঠনে সায় দিলে সেখানে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানোর আশা রয়েছে। এই অঙ্ক মাথায় রেখে তেলঙ্গানা গঠনের জন্যই ঝাঁপ দিলেন সনিয়া। সে জন্য সীমান্ধ্রের কংগ্রেস সাংসদদের বহিষ্কার করা থেকে শুরু করে তাঁদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব সঙ্কটে ফেলতেও দ্বিধা করলেন তিনি। কংগ্রেস নেতৃত্ব মনে করছেন, এর পর তেলঙ্গানায় অন্তত ঝড় তুলতে পারবেন তাঁরা।
লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেসের এই অঙ্ক আঁচ করেই তেলঙ্গানা বিল পাশে এত দিন বাধা দিচ্ছিলেন সুষমা-আডবাণীরা। তাঁদের মত ছিল, বিলটি পাশ করাতে না পারলে কংগ্রেসের দু’কূলই যাবে। কিন্তু বাধ সাধেন নরেন্দ্র মোদী এবং অরুণ জেটলি। তাঁদের মতে, তেলঙ্গানা বিল এখনই পাশ হয়ে যাওয়া ভাল। না হলে ভবিষ্যতে বিজেপি কেন্দ্রে সরকার গঠন করলে এই ঝামেলা সামলাতে হবে তাঁদেরই। শেষ পর্যন্ত মোদী-জেটলিদের মতটাই প্রাধান্য পায়।
বিজেপি পাশে এসে দাঁড়ানোর পরে তেলঙ্গানা বিল পাশ করাতে আজ বিশেষ বেগ পেতে হয়নি সরকারকে। অন্ধ্রপ্রদেশ পুনর্গঠন বিল লোকসভায় পেশ করার সময় গত বুধবার সংসদে তাণ্ডব করেছিলেন সীমান্ধ্রের কিছু সাংসদ। এমনকী পেপার-স্প্রে-ও ছড়িয়ে দিয়েছিলেন লোকসভায়। সীমান্ধ্রের ওই সাংসদদের সে দিনই সাসপেন্ড করা হয়েছিল। কিন্তু তার পরেও আজ কোনও ঝুঁকি নেয়নি সরকার। সংসদ ভবন চত্বর জুড়ে রাখা হয় নজিরবিহীন নিরাপত্তা। এমনকী বিল পাশের সময় লোকসভার লবি পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়। সংসদে এই বিল পাশের ছবি যাতে অন্ধ্রপ্রদেশে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা না করে, সে জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় লোকসভা টিভি চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচারও। আর তার মাঝেই ধ্বনি ভোটে পাশ করিয়ে নেওয়া হয় অন্ধ্রপ্রদেশ পুনর্গঠন বিল।
এত কিছুর পরেও লোকসভার অন্দরে গোলমাল ঠেকানো যায়নি ঠিকই, তবে তা কখনওই মাত্রা ছাড়ায়নি। চার জন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী-সহ সীমান্ধ্রের ৯ জন সাংসদ আজও ওয়েলে নেমে বিলের বিরুদ্ধে স্লোগান তোলেন। আর সেই বিরোধিতায় গলা মেলান সিপিএম এবং তৃণমূল সাংসদরা! যদিও বিলের পক্ষে গরিষ্ঠ সংখ্যক সাংসদের সমর্থন থাকায় বিলটি পাশ করাতে সমস্যা হয়নি।লোকসভায় অন্ধ্র পুনর্গঠন বিল পাশ হতেই আনন্দে নেচে ওঠেন পোন্নম প্রভাকর, বিজয়াশান্তির মতো তেলঙ্গানার সাংসদরা। আর সংসদের বাইরে সরব হন বিরোধীরা। বাম ও তৃণমূল সাংসদদের অভিযোগ, গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করে বিল পাশ করল সরকার। বিরোধীদের এই সুরে সুর মেলান সীমান্ধ্রের কংগ্রেস, তেলুগু দেশম এবং ওয়াইএসআর কংগ্রেস নেতারা। ওয়াইএসআর কংগ্রেসের প্রধান জগন্মোহন রেড্ডি আজ বিল পাশের পরেই জানিয়ে দেন, কাল সীমান্ধ্রে বন্ধ পালন করবেন তাঁরা।
বিলে সমর্থন জানালেও লোকসভা টিভি-র সরাসরি সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়ার জন্য সরকারের সমালোচনায় অবতীর্ণ হন বিজেপি নেতৃত্ব। অন্য দলগুলিও সম্প্রচার বন্ধ রাখা নিয়ে সরকার তথা লোকসভার স্পিকার মীরা কুমারকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেছে। যা সামাল দিতে গিয়ে কংগ্রেস নেতৃত্ব প্রথমে সম্প্রচার বন্ধ রাখাকে স্বাভাবিক ঘটনা এবং পুরোটাই স্পিকারের এক্তিয়ারভুক্ত বলে দায় এড়াতে সচেষ্ট হন। যদিও পরে লোকসভার তরফে বিবৃতিতে জানানো হয়, এটা নিছকই প্রযুক্তিগত সমস্যা।
এখন প্রশ্ন, এ বার কী হবে? একাধিক রাজনৈতিক নেতার মতে, তেলঙ্গানা বিল লোকসভায় পাশ হলেও নাটক যে আজই শেষ হচ্ছে, তা নয়। বরং রাজ্যভাগ নিয়ে যে বিপরীত ছবি আজ ফুটে উঠল, তাতেই ভবিষ্যতের ছবিটাও ধরা রয়েছে বলে মনে করছেন তাঁরা। এটা স্পষ্ট যে, তেলঙ্গানার ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সমীকরণ তুলনামূলক সহজ। এর পর তেলঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতি-র নেতা চন্দ্রশেখর রাও তাঁর দলকে কংগ্রেসের সঙ্গে মিশিয়ে দেবেন কি না, সেটাই এখন প্রশ্ন।
কিন্তু জটিল হয়ে গেল সীমান্ধ্রের অঙ্ক। আর তার নেপথ্যেও দশ জনপথের হাত রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। কারণ, লোকসভা ভোটে সীমান্ধ্রে প্রধান রাজনৈতিক বিষয়ই হয়ে উঠতে চলেছে রাজ্যভাগ। সেই আবেগকে পুঁজি করে এর মধ্যেই নেমে পড়েছেন জগন ও চন্দ্রবাবু নায়ডু। জগনের সঙ্গে সিপিএমের সমঝোতার কথাও চলছে। কিন্তু তার মাঝেই এ বার তৃতীয় শক্তি হিসেবে অবতীর্ণ হতে চলেছেন অন্ধ্রপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কিরণ কুমার রেড্ডি। কাল মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে
তিনি পৃথক রাজনৈতিক দল গড়তে পারেন। আজ সন্ধ্যায় তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনি ফোনে কথাও বলেন। কিরণ রেড্ডির সঙ্গে সামিল হতে পারেন সীমান্ধ্রের কংগ্রেস সাংসদরা। অনেকের মতে, এই খেলাটাও আসলে কংগ্রেসেরই। নতুন রাজনৈতিক দল আসন জিততে পারলে ভোটের পর তারা কংগ্রেসেরই হাত ধরবে। |
|
|
|
|
|