তিন সন্তান জন্মানোর পরে বেলডাঙার টগর খাতুনকে ‘তালাক’ দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেন স্বামী। মামার বাড়িতে গঞ্জনা সইতে না পেরে কাজের সন্ধানে দিল্লি পাড়ি দেন ওই মহিলা। পরিচারিকার কাজ দেওয়ার নামে তাঁকে পাচারের চেষ্টা হয়। কোনও রকমে আড়কাঠিদের নাগাল এড়িয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন তিনি। হরিহরপাড়ার ‘নাবালিকা’ জ্যোৎস্না খাতুনের তালাকের অভিজ্ঞতা আরও খারাপ। ডাকপিয়নের কাছ থেকে স্বামীর চিঠির খাম খুলতেই দেখেনআসলে তা তালাকনামা। স্বামী পরিত্যক্তা, তালাকপ্রাপ্তা এমন বহু মহিলা মুর্শিদাবাদ জেলার ২৬টি ব্লকে ছড়িয়ে রয়েছে। ওই মহিলাদের নিয়েই রবিবাসরীয় দুপুরে বহরমপুর গ্রান্টহল মঞ্চে এক আলোচনা সভার আয়োজন করল রোকেয়া নারী উন্নয়ন সমিতি। যারা দীর্ঘ দিন ধরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওই মহিলাদের শিক্ষা-সচেতনতা-স্বনির্ভরতার দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। ওই সংস্থার কর্ণধার খদিজা বানু বলেন, “মুর্শিদাবাদ জেলায় তালাকপ্রাপ্ত, স্বামী পরিত্যক্তা অসহায় নারীদের সংখ্যা লক্ষাধিক ছাড়িয়ে গিয়েছে। কাজের সন্ধানে হারিয়ে গিয়ে তাঁরা পাচার হয়ে যাচ্ছে। ফলে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই জেলা নারী পাচারের শীর্ষ স্থানে রয়েছে। শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে নাবালিকা বিবাহের হার ৭২ শতাংশ। ওই সব বন্ধ করতে হলে আইনি সুরক্ষা এবং স্বনির্ভরতা চাই।”
রবিবাসরীয় দুপুরে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে স্বামী পরিত্যক্তা ও তালাকপ্রাপ্তা মহিলাদের ভিড়ে উপচে পড়ে গ্রান্টহলের দর্শকাসন। জেলার বিদ্বজ্জনদের সামনে ওই মহিলাদের কয়েক জন তাঁদের বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। কোনও কোনও মহিলা নিজেদের কথা বলতে গিয়ে শেষ করতে পারেননি। আবেগে গলা বুজে আসে তাঁদের। কেউ মাইক্রোফোন হাতে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তালাকপ্রাপ্তা উরফা খাতুনের অভিযোগ, “স্থানীয় পঞ্চায়েত থেকে কোনও সাহায্য মেলেনি। বিপিএল কার্ডও হয়নি। প্রতি দিন দু’মুঠো খাবার জোটে না।” টগর খাতুন বলেন, “আমার মা-ও তালাক প্রাপ্তা। মা কষ্ট করে আমাদের মানুষ করেছেন। মায়ের মতো আমার জীবনেও একই ঘটনা ঘটল। তিন ছেলেমেয়েকে কী ভাবে বড় করে তুলবএই আশঙ্কা প্রতি মুহূর্তে আমাকে কুরে কুরে খায়।” লুৎফা খাতুন বলেন, “মাথার উপরে বাবাও নেই। মা ও ছোট ভাইদের নিয়ে অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছি। কিন্তু আমিও তো আর পাঁচ জনের মতো স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসারের স্বপ্ন দেখেছিলাম। সুস্থ ভাবে সমাজ আমাদের বাঁচতে দিচ্ছে না। অবিলম্বে এই সমাজের পরিবর্তন দরকার।”
এই অবস্থায় স্বনির্ভর হওয়াটাই যে বাঁচার পথ, তা বিলক্ষণ বুঝছেন মহিলারা। হরিহরপাড়ার জ্যোৎস্না খাতুন বিচ্ছেদের পরে স্কুলে ভর্তি হয়ে নতুন করে লেখাপড়া শুরু করেছেন। এ বছর তিনি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী। একমাত্র সন্তান দশম শ্রেণির ছাত্র। ওই মহিলার কথায়, “মাথা উঁচু করে বাঁচতে হবে। তাই আমি নিজে পড়ব। ছেলেকেও শিক্ষিত করে তুলব।” রানিনগরের সারভানু খাতুন বা জানেরা বিবি সেলাই মেশিন কিনে আর্থিক স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টায় লেগে রয়েছেন। জানেরা বিবি আবার স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত হয়ে গ্রামে মুদি খানার দোকান খুলে বসেছেন।
তবে, সকলের সে মনের জোর নেই। বাঁচার পথ খুঁজতে গিয়ে অনেকেই হারিয়ে যাচ্ছেন অন্ধকারের চোরাগলিতে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তথা সমাজকর্মী আলি হাসান বলেন, “শিক্ষার অভাব ও আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়ার কারণেই তালাকপ্রাপ্ত মহিলাদের সংখ্যা বাড়ছে। মহিলাদের আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে সমাজের পাশাপাশি প্রশাসনেরও দায়িত্ব রয়েছে। সেই সঙ্গে ওই নির্যাতিত মহিলাদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারি প্রকল্প গড়ে তোলা প্রয়োজন।” খদিজা বানুর অভিযোগ, “ওয়াকফ বোর্ড থেকে কোনও অর্থ সাহায্য করা হয় না। সরকারি কোনও প্রকল্প যেমন নেই, তেমনই সংখ্যালঘু দফতরের কোনও সাহায্যও মেলে না ওই মহিলাদের।” তালাকপ্রাপ্তা মহিলাদের আইনি সুরক্ষার দাবিতে মুখ্যমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন খদিজা বানু। |