চুরি-চক্রের সদস্যদের বয়স দেখে তাজ্জব পুলিশ
না ছয়েকের একটি দল। স্বামী-স্ত্রী, তাদের তেরো বছরের এক মেয়ে এবং আটমাসের এক শিশু সন্তান। সঙ্গে ছিল আরও দুই কিশোর। একজনের বয়স বারো, অন্য জনের ষোল। এই দলটিই গত কয়েক মাস ধরে নবদ্বীপের মঠ মন্দিরে একের পর এক চুরির ঘটনায় জড়িত ছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে। ৩১ জানুয়ারি নবদ্বীপের সমাজবাড়িতে চুরি হওয়ার পর তদন্তে নেমে ওই দলের সদস্যদের বয়স দেখে তাজ্জব হয়ে গিয়েছেন জেলার দুঁদে পুলিশ অফিসারেরাও। সোমবার কৃষ্ণনগর জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ড সেই আবেদনের ভিত্তিতে ওই কিশোরীকে নগেন্দ্রনগরের সরকারি হোমে এবং দুই কিশোরকে ঘূর্ণিতে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিচালিত হোমে ১৪ দিন পর্যবেক্ষণে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
নবদ্বীপের আইসি তপনকুমার মিশ্র বলেন, “সমাজবাড়ির চুরির তদন্তে নেমে বেশ কিছু সূত্র ধরে আমরা এগিয়েছিলাম। গত শুক্রবার নবদ্বীপের মাঝেরপাড়া থেকে অজিত হাড়ি ও তার স্ত্রী পুতুল হাড়িকে গ্রেফতার করি। তাদের পুলিশ হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করে আমরা ওই তিন কিশোর কিশোরীর হদিশ পাই। নিজের শিশু সন্তানদের ব্যবহার করে কোনও মা-বাবা যে এভাবে চুরি করতে পারে তা জানতে পেরে আমরাও অবাক।”
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রায় সাত আট মাস ধরে নবদ্বীপের বিভিন্ন মঠ মন্দিরে একের পর এক চুরির ঘটনা ঘটছিল। কোথাও বিগ্রহ, কোথাও অলংকার চুরি, কোথাও আবার লোপাট করে দিয়েছিল আস্ত রুপোর সিংহাসনটিও। কিন্তু জানুয়ারির শেষে এক সপ্তাহের ব্যবধানে পরপর তিনটি মন্দিরে বড় মাপের চুরি হওয়ায় নড়েচড়ে বসে পুলিশ। সমাজবাড়িতে চুরির তদন্তে শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে শিশু, কিশোরদের ব্যবহার করে চুরির সঙ্গে যুক্ত থাকা ওই দম্পতি।
ধৃত ওই দম্পতির বিরুদ্ধে পুলিশ আইনি ব্যবস্থা নিলেও তিন শিশু কিশোরের বিরুদ্ধে অবশ্য কোনও অভিযোগ আনা হয়নি। আইসি বলেন, “সোমবার ভোরে ধরা হয় ওই কিশোরী সহ তিন জনকে। আমরা ওদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ আনিনি। আমাদের মনে হয়েছে, ওই তিনজনই অভাব এবং পরিস্থিতির শিকার। সুযোগ পেলে ওরা সমাজের মূলস্রোতে ফিরতে পারবে। তাই আমরা আবেদন করেছি, যতদিন পর্যন্ত না ওরা সাবালক হচ্ছে, ততদিন যাতে ওদের কোনও হোমে রেখে পড়াশোনা, হাতের কাজ শেখানো হয়।’’
কীভাবে চুরি করত এই দলটি? পুলিশ জানিয়েছে, ওই হাড়ি দম্পতি তেরো বছর এবং আট মাসের দুই মেয়েকে নিয়ে যাত্রী সেজে ঘুরে বেড়াত বিভিন্ন মঠ-মন্দিরে। তারা নিজেদের ভিক্ষাজীবী বলে পরিচয় দিত। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মন্দির কর্তৃপক্ষ ওই দুই শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের মন্দির চত্বরে থাকার ব্যাপারে আপত্তি করতেন না। সেই সুযোগে তারা সাজিয়ে নিত চুরির ছক। বছর চল্লিশের অজিত হাড়ি এক সময় নবদ্বীপ পুরসভায় অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে কাজও করেছে। তারপর জড়িয়ে পড়ে চুরির সঙ্গে। তার নামে আরও কিছু চুরির অভিযোগ পুলিশের খাতায় আছে। আইসি বলেন, “নবদ্বীপ, সমুদ্রগড় এবং পূর্বস্থলী এলাকায় চুরি করে বেড়াত এই দলটি। থাকত সমুদ্রগড় রেল স্টেশনের আশপাশে।”
দলের বাকি দুই সদস্যকে নবদ্বীপ থেকেই জুটিয়ে নিয়েছিল ওই দম্পতি। বারো বছরের সদস্যটি একসময় নবদ্বীপের এক প্রাথমিক স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র ছিল। মায়ের মৃত্যুর পর রিক্শাচালক বাবা মদ খেয়ে এসে মৃত মাকে গালাগালি করতে শুরু করলেই বাড়ি থেকে ছুটে বেড়িয়ে যেত ওই কিশোর। রাত কাটাত শহরের কোনও মঠ মন্দিরে। এভাবে রাত কাটাতে গিয়েই ওই দম্পতির নজরে পড়ে সে। পুলিশ জানিয়েছে, চুরির সময় এই বারো বছরের ছেলেটি এবং ওই দম্পতির তেরো বছরের মেয়েটির কাজ ছিল আটমাসের শিশুটিকে কোলে নিয়ে বাইরে বসে থাকা এবং কোনও বিপদ বুঝলে নানারকম সংকেত দিয়ে সতর্ক করে দেওয়। পাশাপাশি ছোটখাট হাত সাফাইয়ের কাজেও হাত পাকাচ্ছিল তারা।
দলের আর এক সদস্য, বছর ষোলোর ওই কিশোর অবশ্য ইতিমধ্যে একাধিক চুরির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে পুলিশ জানিয়েছে। জানা গিয়েছে, খুব ছোট থেকেই ছেলের এমন কাণ্ডকারখানায় বছর কয়েক আগে আত্মঘাতী হয়েছেন ভ্যানচালক বাবা। তার মা পরিচারিকার কাজ করেন। তবে ছেলেকে তিনি বাড়িতে ঢুকতে দেন না। কোথায়, কবে, কীভাবে চুরি করেছিল সব নিজে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে পুলিশকে দেখিয়েছে ওই কিশোর।
শিশু অপরাধ প্রসঙ্গে চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটির নদিয়া জেলার চেয়ারপার্সন এবং সমাজত্তত্ববিদ রিনা মুখোপাধ্যায় বলেন, “এদের বলা হয় আইনের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া শিশু। মূলত দারিদ্র এবং অশিক্ষার কারণে এরা অপরাধ জগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি চারপাশের নানা কিছুর প্রভাবে এরা দ্রুত বেশি টাকা রোজগারের দিকেও ঝুঁকে পড়ে। বহু ক্ষেত্রে বাবা-মা তাদের এই কাজে মদতও দেয়। কিছু ক্ষেত্রে সঙ্গদোষে অপরাধের জালে জড়িয়ে পড়ে শিশু-কিশোরের দল। লেখাপড়া বা হাতের কাজ শেখালে কিংবা কালচারাল কাউন্সেলিং করালে ফের এরা মূলস্রোতে ফিরতে পারে।” নদিয়ার জেলা শাসক পি বি সালিম বলেন, “আমরা দেখছি ওদের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্য কী করা যায়।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.