|
|
|
|
দাম কমালেন, রইল ভর্তুকিও তবু লাগামছাড়া নন চিদম্বরম
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি
১৭ ফেব্রুয়ারি |
অর্থনীতির করুণ দশা। নুন আনতে পান্তা ফুরনোর অবস্থা রাজকোষের। ভোটের বছর হলেও তাই জনগণের মনোরঞ্জনের চেষ্টা না-করে বাস্তবমুখী অন্তর্বর্তী বাজেট পেশ করল মনমোহন সিংহের সরকার। লাগামছাড়া খরচ না-করে অর্থমন্ত্রী পালানিয়াপ্পন চিদম্বরম আজ রাজকোষ ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রেখে অর্থনীতির ভিত শক্ত করার উপরেই বেশি জোর দিলেন।
আমআদমি ও মধ্যবিত্তের জন্য খুশির খবর বলতে, যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য মূলধনী পণ্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর উৎপাদন শুল্কের হার ১২% থেকে কমিয়ে ১০% করা হয়েছে। যার ফলে সব ধরনের দু’চাকা ও চার চাকার গাড়ি, মোবাইল, সাবান থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম কমবে। অন্তর্বর্তী বাজেট বলে আয়করের হারে রদবদল করা সম্ভব ছিল না। তাই জিনিসপত্রের দাম কমিয়েই মধ্যবিত্তকে সন্তুষ্ট করতে চেয়েছেন তিনি। তাতে অবশ্য শিল্পমহলও খুশি। কারণ, এই সব জিনিসের দাম কমলে বিক্রিও বাড়বে। বাড়বে উৎপাদন। |
|
বাজেট পেশ করতে সংসদে ঢুকছেন অর্থমন্ত্রী। নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই। |
জনমোহিনী না-হলেও নির্বাচনের বছরে অন্তর্বর্তী বাজেট বক্তৃতাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাজে লাগাতে চেয়েছেন চিদম্বরম। হাত-পা বাঁধা থাকা সত্ত্বেও মধ্যবিত্ত ও শিল্পমহলের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করেছেন। সামাজিক উন্নয়নের পথে হেঁটেও কী ভাবে তিনি আন্তর্জাতিক মন্দার হাত থেকে দেশের অর্থনীতিকে আগলে রেখেছেন, কী ভাবে অর্থনীতির মোড় ঘোরানোর চেষ্টা করেছেন এবং কী ভাবে মূল্যবৃদ্ধিতে লাগাম পরাচ্ছেন তা ফলাও করে বলেছেন।
তেলঙ্গানা নিয়ে হাঙ্গামার জন্য সপ্তমে গলা চড়িয়ে বাজেট পাঠ করতে হয়েছে চিদম্বরমকে। কিন্তু হাল ছাড়েননি। বার বার জলে গলা ভিজিয়ে মনমোহন সরকারের দশ বছরের জমানায় দেশের অর্থনীতির কতখানি উন্নতি হয়েছে, তার ঢাক পিটিয়েছেন। উড়িয়ে দিয়েছেন নীতিপঙ্গুত্বের অভিযোগ। সংস্কারের গতি রোধের জন্য বিরোধীদের দুষতেও ছাড়েননি। নাম না-করে কটাক্ষ করেছেন নরেন্দ্র মোদীকে। রাহুল গাঁধীর প্রতিশ্রুতি মতো অবসরপ্রাপ্ত ফৌজিদের ‘এক পদ, এক পেনশন’-এর দাবি মেনে নিয়েছেন। ইউপিএ ক্ষমতায় ফিরলে রূপায়ণ করা হবে জানিয়ে দশ দফা অর্থনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। সব মিলিয়ে বার্তা দিতে চেয়েছেন, তিনি চমকের থেকেও অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে বিশ্বাসী। |
|
এক বছর আগে বাজেট পেশ করার সময় চিদম্বরমের সবচেয়ে বড় মাথাব্যথা ছিল রাজকোষ ঘাটতি ও বৈদেশিক লেনদেনের চলতি খাতে (অর্থাৎ বিদেশি মুদ্রা আয়ব্যয়ের) ঘাটতি। প্রথমটির থেকেও দ্বিতীয়টি বেশি দুশ্চিন্তাজনক হয়ে উঠেছিল। কারণ, বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারে টান পড়ছিল। আজ চিদম্বরম জানিয়েছেন, দু’টিকেই লাগাম পরাতে পেরেছেন তিনি। রাজকোষ ঘাটতি, অর্থাৎ সরকারি আয় ও ব্যয়ের ঘাটতিকে ৪.৮ শতাংশে বেঁধে রাখার লক্ষ্য নিয়েছিলেন। বছর শেষে তা ৪.৬ শতাংশে টেনে নামানো গিয়েছে। আগামী বছর একে ৪.১ শতাংশে কমিয়ে আনার লক্ষ্য ঘোষণা করেছেন চিদম্বরম। বৈদেশিক লেনদেনের ঘাটতি গত বছরের ৮৮০০ কোটি ডলার থেকে কমে এসেছে ৪৫০০ কোটি ডলারে। বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারে যোগ হবে ১৫০০ কোটি ডলার।
সেই সঙ্গে গরিব থেকে মধ্যবিত্ত মানুষের মাথাব্যথা মূল্যবৃদ্ধিতেও রাশ টানা সম্ভব হয়েছে বলে চিদম্বরমের দাবি। তাঁর কথায়, “দু’বছর আগের তুলনায় অর্থনীতি অনেক স্থিতিশীল। ঘাটতি কমেছে, মূল্যবৃদ্ধি কমেছে, আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়ছে, ডলারের তুলনায় টাকার দামও বেশি ওঠানামা করছে না, রফতানি বাড়ছে ও আটকে থাকা কয়েকশো প্রকল্পে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।” চিদম্বরমের যুক্তি,চলতি অর্থবর্ষে আর্থিক বৃদ্ধির হার ৪.৯ শতাংশে পৌঁছবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। যার অর্থ শেষ ছ’মাসে বৃদ্ধির হার ৫.২ শতাংশ হবে। অর্থনীতির চাকা অল্প হলেও ঘুরছে। ফলে আগামী বছর বৃদ্ধির হারকে ৬ শতাংশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ বার জনমোহিনী বাজেট করে খয়রাতি করার উপায়ও ছিল না। আয়ের তুলনায় ব্যয় এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে চিদম্বরমের হাত-পা বাঁধা ছিল।
বৃদ্ধির হার কমায় কর্পোরেট সংস্থা থেকে চাকুরিজীবী, ব্যবসায়ীর আয় কমেছে। তাই কর বাবদ আয় কমেছে সরকারের। স্পেকট্রাম নিলাম করে ঘরে যথেষ্ট টাকা তুললেও বিলগ্নিকরণ থেকে ৪০ হাজার কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্য পূরণ হয়নি। উল্টো দিকে জ্বালানি, সার ও খাদ্যে ভর্তুকির বহর বেড়েছে। চিদম্বরমের হিসেব ছিল, এ বছর ভর্তুকি বাবদ প্রায় ২ লক্ষ ২১ হাজার কোটি টাকা মেটাতে হবে। কিন্তু বছরের শেষে তা ২ লক্ষ ৪৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছে। যোজনা বহির্ভূত খাতে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা খরচ বেড়েছে। |
|
আয়-ব্যয়ের ফারাক বেড়ে যাওয়ায় ফলে ঘাটতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাই খরচ কমাতে হয়েছে চিদম্বরমকে। যোজনা খাতে তিনি প্রায় ৭৯ হাজার কোটি টাকা খরচ কমিয়েছেন। পরিকল্পনা খাতে ব্যয়বরাদ্দে কোপ পড়ার অর্থ নতুন পরিকাঠামো কম তৈরি হওয়া। তাতে আখেরে অর্থনীতিরই ক্ষতি। চিদম্বরম অবশ্য যুক্তি দিয়েছেন, তিনি বছরের শুরুতে অতিরিক্ত বরাদ্দ করে রেখেছিলেন, যার পুরোটা খরচ হয়নি। এটা তাই খরচে কোপ নয়, সঞ্চয়। চিদম্বরমের কথায়, “যেখানে পরিকল্পনা খাতে ৫ লক্ষ ৫৫ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ ব্যয় হচ্ছে, সেখানে ৭৯ হাজার কোটি টাকা কম হলে অর্থনীতিতে বিরাট প্রভাব পড়বে না।” যদিও অঙ্কটা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১২ শতাংশ কম।
আম আদমির মন জয়ে কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীর সবথেকে বড় অস্ত্র সামাজিক সুরক্ষার প্রকল্পগুলি। সরকারি খরচ কমালেও চিদম্বরম জানিয়েছেন, গ্রামোন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জল, নারী ও শিশুকল্যাণ, আদিবাসী ও সংখ্যালঘু উন্নয়ন বা দারিদ্র দূরীকরণের মতো কোনও খাতেই ব্যয়বরাদ্দ কমানো হয়নি। হয় বেড়েছে, না হয় আগের বছরের মতো একই আছে। একশো দিনের কাজ, প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা, বিদ্যুদয়ন, খাদ্য সুরক্ষা আইনের মতো যে সব প্রকল্প ইউপিএ-র তুরুপের তাস বলে পরিচিত, তার সবগুলিতেই ব্যয়বরাদ্দ বেড়েছে। আগামী বছর খাদ্য সুরক্ষায় ভর্তুকি ২৩ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ১ লক্ষ ১৫ হাজার কোটি টাকা করেছেন চিদম্বরম। রান্নার গ্যাস, কেরোসিন, ডিজেলের মতো জ্বালানিতে ভর্তুকি দিতে ব্যয় হবে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি কৃষি ঋণ, সংখ্যালঘুদের জন্য ঋণ, স্বনির্ভর গোষ্ঠী, শিক্ষার জন্য ঋণের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য জোর দিয়েছেন তিনি। শিক্ষা বাবদ ঋণে সুদের হারে ভর্তুকি বাড়ানো হচ্ছে। যাতে ৯ লক্ষ ছাত্রছাত্রী উপকৃত হবেন। কিন্তু এতে আমআদমির মন জয় করা যাবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। একই ভাবে উৎপাদন শুল্ক বা গাড়ির উপর শুল্ক কমিয়ে শিল্পক্ষেত্রকে কতখানি চাঙ্গা করা যাবে, তা নিয়েও অনেকে সন্দিহান। প্রশ্ন হল, গাড়ি শিল্পকে চাঙ্গা করতে কেন আগেই করের হার কমানো হল না! এমনিতেও এই কর ছাড় দেওয়া হচ্ছে নতুন সরকার গঠনের পর সাধারণ বাজেট পেশ হওয়া পর্যন্ত। করের হার কমানোর ফলে সরকারের যে রাজস্ব ক্ষতি হবে, তা কী ভাবে মেটানো হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। চিদম্বরম অবশ্য যুক্তি দিয়েছেন, উৎপাদন শুল্ক কমানোর ফলে চলতি বছরের বাকি ৪০ দিনে ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা আয় কম হবে। এপ্রিল ও মে মাসে আরও ৭০০ থেকে ৮০০ কোটি টাকা কম আয় হবে। কিন্তু দাম কমে যাওয়ার ফলে যদি গাড়ি ও অন্যান্য পণ্যের বিক্রি ৫ শতাংশও বাড়ে, তা হলে এই ক্ষতি পূরণ হয়ে যাবে।
চিদম্বরম অবশ্য বলছেন, “প্ররোচনায় পা দিই না। পরিস্থিতি অনুযায়ী যেটা ঠিক, সেটাই করি। প্রধানমন্ত্রী ও ইউপিএ সভানেত্রীর সমর্থন ছিল। সহকর্মীরাও বুঝেছিলেন সময়টা কঠিন। কাউকে খুশি করতে চাইনি। দেশের সামনে অর্থনীতির আসল ছবিটাই তুলে ধরতে চেয়েছি।” |
এক নজরে কেন্দ্রীয় বাজেট |
• বদলাল না আয়করের হার।
• বছরে কোটি টাকা আয়ের উপরে ১০% সারচার্জ রইল।
• রাজকোষ ঘাটতি জাতীয় আয়ের ৪.৬%।
• চলতি খাতে বিদেশি মুদ্রা আয়-ব্যয়ের ঘাটতি কমে ৪,৫০০ কোটি ডলার।
• উৎপাদন শুল্ক কমলো মূলধনী পণ্য।
• ২০০৯ সালের ৩১ মার্চের আগে নেওয়া শিক্ষা ঋণেও সুদ মকুবের সুবিধা।
• ভবিষ্যতে ফের আধার চালুর প্রতিশ্রুতি। |
|
|
|
|
|
|