সংশয়ে ব্যাঙ্ক, ঋণ অধরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের
মন্ত্রণ আছে বটে। কিন্তু ব্যাঙ্কের দরজা থেকে তাঁদের ফিরতে হচ্ছে কার্যত শূন্য হাতে।
বিভিন্ন জেলার আনাচ কানাচ থেকে জেলা ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প দফতরে নাগাড়ে জমা পড়ছে এমনই অভিযোগ। ক্ষুদ্র এবং মাঝারি মাপের উদ্যোগপতিদের দাবি, ঋণের প্রশ্নে ব্যাঙ্কগুলি তাদের প্রচারে যতটা ‘উদার’, দেওয়ার ব্যাপারে ঠিক ততটাই ‘কৃপণ’।
ছোট মাপের উদ্যোগপতিদের কাছে প্রয়োজনীয় ঋণের সুযোগ রয়েছে বলে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি প্রচারের বিরাম নেই। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা কিঞ্চিৎ ভিন্ন বলে তাঁদের দাবি। বর্ধমান, হাওড়া, কিংবা হুগলি ও দুই ২৪ পরগনা--মাঝারি মাপের কল-কারখানা কিংবা পশু পালনের ছোট ব্যবসার প্রসার ঘটা ওই জেলাগুলি থেকে ক্রমাগত অভিযোগ আসছে, প্রচারে ঋণের বন্যা বইয়ে দিলেও আদপে ঋণের ছিটেফোঁটাও জুটছে না উদ্যোগপতিদের।
শিল্প-ব্যণিজ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা স্পষ্টই বলছেন, “ঢালাও প্রচার হলেও ঋণের প্রশ্নে ব্যাঙ্কগুলির বেশ রক্ষণশীল। তাগের এই আচরণ নিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক কর্তাদের সঙ্গে সম্প্রতি বৈঠকও হয়েছে কুটির শিল্প দফতরের।” তবে, বলাই বাহুল্য সে আলোচনার পরেও স্পষ্ট কোনও সমাধান সূত্র বেরোয়নি। কেন?
ব্যাঙ্কগুলির তরফে সরকারি ভাবে জানানো হয়েছে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে বিশেষ কোনও ‘বাধা’ নেই। তবে, ব্যাঙ্ক কর্তারা পরোক্ষে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন প্রকল্পগুলি বাস্তবে কতটা লাভজনক হবে তা নিয়ে তৈরি হওয়া সংশয়ই ঋণ দেওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প দফতরের মন্ত্রী স্বপন দেবনাথেরও নজর এড়ায়নি বিষয়টি। তিনি বলেন, “শিল্পপতিদের ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে ব্যাঙ্কগুলি যতটা উদার ছোট ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে ঠিক ততটাই রক্ষণশীল। সামান্য ঋণের ভরসাতেই রাজ্যের বহু বেকার ছোট বা মাঝারি শিল্পের দিকে ঝুঁকছেন। কিন্তু ব্যাঙ্ক তাঁদের পাশে সে ভাবে দাঁড়াচ্ছে কোথায়!” মন্ত্রী অবশ্য জানান, ছোট উদ্যোগপতিদের একাংশের লক্ষ্য অবশ্য যে কোনও উপায়ে ঋণের টাকা হাতে পাওয়া। অনেকেই ঋণের টাকা ফেরতও দিচ্ছেন না। তবে, তাঁরা কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ নন। স্বপনবাবু বলেন, “তার মানে অবশ্যই এই নয় যে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কোনও ভাবেই ঋণ দিয়ে উৎসাহিত করা যাবে না।” এই সামঞ্জস্যটাই জরুরি বলে মনে করছেন ওই দফতরের কর্তারাও।
উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল দু-দশক আগেও ছিল ছোট শিল্পের আঁতুর ঘর। টিটাগড়, কাঁকিনাড়া, ব্যারাকপুর হয়ে সেই শিল্পের প্রসার ঘটেছিল কল্যাণী, কাঁচরাপাড়া পর্যন্ত। কিন্তু গত কয়েক বছরে ওই এলাকায় ছোটখাটো যন্ত্রপাতি থেকে বোতলের ছিপি-ঢাকনা তৈরির মতো নিতান্তই ছোট মাপের কারখানাগুলি একে একে বন্ধ হওয়ার মুখে। নতুন করে ঋণের সুযোগও প্রায় বন্ধ।
ব্যারাকপুর এলাকায় ছোট একটি লেদ মেশিন বসিয়ে কারবারের উপায় খুঁজতে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কাছে ২ লক্ষ টাকা ঋণ চেয়েছিলেন শুভেন্দুবিকাশ দাস নামে এক যুবক। তাঁর অভিজ্ঞতা, “পাক্কা তিন বছর ধরে ঘুরেও সেই ঋণ শেষ পর্যন্ত পেলাম না।” বাধ্য হয়ে স্থানীয় একটি মুদির দোকানে কর্মচারীর কাজ নিয়েছেন তিনি। কাঁচরাপাড়ার স্বপন অধিকারীও একটি ফোটোকপি মেশিন কেনার জন্য ৩ লক্ষ টাকা ঋণ চেয়ে দু-বছর হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেও একটি রাষ্ট্রয়ত্ত ব্যাঙ্কের কাছ থেকে ঋণ না পেয়ে অবশেষে কাজ নিয়েছেন ক্যুরিয়র সংস্থায়। বাঁকুড়ার ইন্দাস এলাকায় মুরগি প্রতিপালনের জন্য নারায়ণ সমাদ্দারের দাবি ছিল সাকুল্যে দেড় লক্ষ টাকা ঋণ। বিষ্ণুপুর ও সোনামুখী এলাকায় তিনটি ব্যাঙ্কের দুয়ারে ঘুরে শেষতক সে ব্যবসার স্বপ্ন মুছে ফেলেছেন তিনি। নারায়ণ বলেন, “তিন বছর ঘোরার পরে ঋণ-মঞ্জুর হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন ওই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্তারা। কিন্তু আচমকা ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার বদলি হয়ে যাওয়ায় তা আর শেষ পর্যন্ত দিনের আলো দেখল না।” সারা ভারত জরিশিল্প কল্যাণ সমিতির সভাপতি মুজিবর রহমান মল্লিকও জানান, উলুবেড়িয়ার জরি শিল্পীদের অভিজ্ঞতাও প্রায় একই রকম।
অথচ ঋণ পেতে উদ্যোগপতিদের ঠিক কী ধরনের অসুবিধা হচ্ছে তা সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে কিছু দিন আগে বহরমপুরে এসেছিলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের শীর্ষ কর্তারা। সেখানে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চিফ জেনারেল ম্যানেজার ই ই করথক বলেন, “মুর্শিদাবাদ জেলায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের মোট ৩২৯টি শাখা রয়েছে। অথচ এই জেলায় ঋণ দেওয়া হয় মাত্র .৩ শতাংশ। ক্ষুদ্র উদ্যোগের জন্য ব্যাঙ্কের কোনও বন্ধক ছাড়াই ঋণ দেওয়ার কথা। সেক্ষেত্রে দেখতে হবে আবেদনটি ঠিকঠাক করা হয়েছিল কিনা। আবেদন ঠিক হলে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণের জন্য ২ সপ্তাহ, ৫ লক্ষ টাকা থেকে ২৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণের জন্য ৪ সপ্তাহ এবং ২৫ লক্ষ টাকার উপর ঋণের জন্য ৮ সপ্তাহ সময় নেওয়ার কথা ব্যঙ্কগুলির। ব্যাঙ্ক বিশেষে ওই সময় সীমার সামান্য হেরফের অবশ্য হতে পারে।”
তবে, ছোট মাপের উদ্যোগীদের অহরহ এমন হেনস্থার একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় বিভাগের এক শীর্ষ কর্তা। তিনি বলেন, “ব্যাঙ্কগুলি কিন্তু লাভজনক ব্যবসায় ঋণ দিতে আগ্রহী। কিন্তু ছোট ব্যবসায়ীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যবসার যে রূপরেখা বা ‘প্রোপোজড্ প্রোজেক্ট রিপোর্ট’ জমা দেন তা কতটা লাভজনক হবে তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। ঋণ-মেলা কিংবা কর্মশালা করেও তাঁদের এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরেও দেখা গিয়েছে রিপোর্ট ঠিকমতো দিতে পারেন না তাঁরা।” ওই ব্যাঙ্ক-কর্তার প্রশ্ন, সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ যদি ঋণ ফেরত পাওয়ার কোনও স্পষ্ট উপায়ই খুঁজে না পান তাহলে ঋণ মঞ্জুর করবেন কী করে?
এ ব্যাপারে, বণিকসভাগুলির পর্যবেক্ষণও প্রায় একইরকম। রাজ্যের পরিচিত একটি বণিকসভার এক কর্তা বলেন, “আমরা সব সময়েই ছোট ব্যবসায়ীদের পাশে রয়েছি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা ব্যবসা কতটা লাভজনক হতে পারে তা স্পষ্ট করতে পারেন না। ঋণ মঞ্জুর করতেও তাই সংশয়ে ভোগে ব্যাঙ্কগুলি।”
প্রতিশ্রুতি রয়েছে, পাশে দাঁড়ানোর ভরসাও জোগাচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু ব্যাঙ্ক কর্তাদের ‘সংশয়’, তা কী করে কাটবে?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.