স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় • বিষ্ণুপুর |
হয়েছিল যমজ সন্তান ছেলে ও মেয়ে। মেয়েটিকে বাঁচানো যায়নি। বেঁচে যাওয়া সেই ছেলেকে নিয়ে দেড় বছর ধরে বিষ্ণুপুর হাসপাতালে দিন কাটছে মানসিক ভারসাম্যহীন মায়ের। কিন্তু পাছে ছেলেকে কেউ তুলে নিয়ে যায়, এই আতঙ্কে অন্য রোগী ও তাঁদের দেখতে আসা পরিজনদের দিকে মাঝে মধ্যেই তেড়ে যাচ্ছেন সেই মা। কখনও সখনও থালা-বাটিও তাঁদের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছেন। তাঁর আক্রমণে সম্প্রতি মেহেরুন্নেষা বিবি নামে এক রোগিনী আহত হয়েছেন বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অভিযোগ। ওই মানসিক রোগী মাকে নিয়েই জেরবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শেষে বিষ্ণুপুরের মহকুমাশাসকের দ্বারস্থ হয়েছেন। |
বিষ্ণুপুর হাসপাতালে ছেলেকে নিয়ে গৌরি বেরা। ছবি: শুভ্র মিত্র। |
হাসপাতাল সুপার সুভাষচন্দ্র সাহা বলেন, “বছর দেড়েক আগে গৌরি বেরা নামে মানসিক রোগী এক প্রসূতিকে ভর্তি করে যান স্থানীয় প্রবুদ্ধ ভারতী হোমের সুপার। সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর থেকে ওই মানসিক রোগিনী এখানেই রয়ে গিয়েছে। হোম কর্তৃপক্ষ তাঁকে নিয়ে যাননি। কিন্তু এখন ওই মানসিক রোগিনীর হাতে বহু রোগী ও তাঁদের আত্মীয়েরা মারধর খাচ্ছেন। তাঁকে অন্যত্র পাঠানোর জন্য মহকুমাশাসককে জানানো হয়েছে।”
প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ওন্দার নাকাইজুড়ি অঞ্চলের মৌদি গ্রামের প্রাথমিক স্কুল থেকে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আলুথালু অবস্থায় ওই মহিলাকে পাওয়া যায়। তাঁকে ওন্দা ব্লক প্রাথমিক চিকিত্সা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, চিকিত্সকরা পরীক্ষা করে জানিয়েছিলেন, তিনি অন্তঃসত্ত্বা। ওন্দার বিএমওএইচ অভিজিত্ দেওঘরিয়া বলেন, “ওই মহিলা মানসিক ভারসাম্যহীন। নিজের পরিচয় জানাতে পারেননি। কয়েকদিন তাঁর চিকিত্সা করিয়ে বিডিও-র পরামর্শে বিষ্ণুপুরে মেয়েদের একটি হোমে পাঠানো হয়।”
হোম সূত্রে জানা যায়, পরের মাসে সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য তাঁকে হোম থেকে বিষ্ণুপুর হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি একটি ছেলে ও মেয়ের জন্ম দেন। ছেলেটি বেঁচে গেলেও মেয়েটিকে বাঁচানো যায়নি। কিন্তু বাচ্চা-সহ ওই মহিলাকে আর ওই হোম ফিরিয়ে নেয়নি। তারপর থেকেই ওই মহিলা ও তাঁর ছেলের ঠাঁই হয় হাসপাতালের ফিমেল ওয়ার্ডে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, তিনি আগে বড় একটা গোলমাল করতেন না বলে ওয়ার্ডের মধ্যে অন্য রোগীদের সঙ্গেই রাখা হচ্ছিল। কিন্তু ইদানীং তাঁর ছেলের দিকে কেউ তাকালেও ওই মহিলা তেড়ে যাচ্ছেন। মারধরও করছেন। ওঁকে নিয়ে অন্য রোগীদের সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় সঙ্কটে পড়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
নাজেহাল বিষ্ণুপুর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ওই মহিলাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য হোম কর্তৃপক্ষকে বারবার জানিয়েছেন। কাজ না হওয়ায় এ বার মহকুমাশাসককেও ঘটনার কথা জানিয়েছেন। বিষ্ণুপুর হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির সদস্য তথা পুরসভার কাউন্সিলর দিব্যেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “কয়েক দিন কয়েক আগে ওই রোগিনী ফিমেল ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা মেহেরুন্নেষা বিবিকে থালা ছুঁড়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছেন। তাঁর মারে আরও অনেকেই জখম হয়েছেন। উনি কখন কী করেন, তা নিয়ে হাসপাতালে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। বিষয়টি মহকুমাশাসককে জানানো হয়েছে।”
ওই হোমের সুপার সুচিত্রা ঘোষ বলেন, “আমাদের হোমে শুধুমাত্র মেয়েদের রাখা হয়। বাচ্চা-সহ মা-কে এখানে রাখা সম্ভব নয়। আমরা বহু চেষ্টা করেও ওই মহিলার নাম ছাড়া আর কিছু জানতে পারিনি। ওঁর সর্ম্পকে আমরা এখনও খোঁজখবর নিই। কিন্তু বাচ্চা-সহ তাঁকে এখানে নিয়ে আসা সম্ভব নয়।” মহকুমাশাসক (বিষ্ণুপুর) পলাশ সেনগুপ্ত বলেন, “ওই মহিলাকে নিয়ে হাসপাতালের সমস্যার কথা জানি। ওই হোমেও অসুবিধা আছে। আগে ওই মহিলার চিকিত্সা করানো দরকার। তাই বাচ্চাটিকে আলাদা রেখে ওই মহিলাকে বাঁকুড়া মেডিক্যালে ভর্তি করিয়ে চিকিত্সা করানোর কথা ভাবা হচ্ছে। তবে এখনও এ ব্যাপারে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।” |