নিজস্ব সংবাদদাতা • বড়জোড়া |
বৃষ্টি ভেজা দুপুরে কাজ সেরে সাইকেল নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন এক যুবক। চোখের সামনে দেখেন এক কিশোরী দৌড়ে এসে রাস্তার পাশে একটি কুয়োয় ঝাঁপ দিল। সাতপাঁচ ভাবার সময় ছিল না। সাইকেলটা ফেলে জামা খুলে সটান কুয়োয় ঝাঁপ মারেন ওই যুবক। রবিবার বড়জোড়া হাইস্কুল এলাকার ঘটনা।
মিলন নিয়োগী।
—নিজস্ব চিত্র।
|
৪০ ফুট গভীর কুয়োয় প্রায় ১৫ ফুট জল। হাবুডুবু খাচ্ছিল মেয়েটি। কুয়োর পাটে নিজের পা আটকে কোনওরকমে ওই মেয়েটিকে জলের উপরে তুলে ধরেন ওই যুবক। ও ভাবে কতক্ষণই বা রাখা যায়! চিত্কার করে লোকজনকে ডাকছিলেন তিনি। কিন্তু বৃষ্টিতে গ্রামের রাস্তায় লোক চলাচল কম ছিল। একটি গাড়ি সেই সময় ওই কুয়োর পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। চিত্কার শুনে চালক গাড়ি থামিয়ে কুয়োর পাড়ে দাঁড়িয়ে নিচে তাকিয়ে অবাক হয়ে যান। তিনিই ডাকাডাকি করে লোকজনকে বাড়ি থেকে ডেকে আনেন। ততক্ষণে মেয়েটি প্রায় নেতিয়ে পড়েছিল। উপর থেকে দড়ি ফেলা হয়। সেই দড়িতে মেয়েটিকে বেঁধে উপরে তোলা হয়। উঠে আসেন সেই যুবক, বড়জোড়ারই বাসিন্দা বছর তেত্রিশের মিলন নিয়োগী। ওই গাড়িতে চাপিয়েই তাঁদের বড়জোড়া ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। দু’জনেরই হাতে ও পায়ে কিছুটা কেটে গিয়েছিল। প্রাথমিক চিকিত্সার পরে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
ওই নাবালিকা বড়জোড়ায় তার মায়ের সঙ্গে মামার বাড়িতে থাকে। তার মামা বলেন, “কয়েক বছর আগে জামাইবাবুর মৃত্যুর পরেই ভাগ্নী মানসিক অবসাদের শিকার হয়। এখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনা করলেও মানসিক অবসাদ কাটেনি। বিভিন্ন জায়গায় ওর চিকিত্সা চলছে। কিন্তু কখন যে সে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কুয়োয় ঝাঁপ দিয়েছিল বুঝতে পারিনি।” তিনি জানান, মিলনের সাহসিকতার জন্যই তাঁরা ওই মেয়েকে ফিরে পেলেন।
এর আগেও পরের জন্য মিলন একাধিকবার ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
মানুষের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার এই প্রেরণা পেলেন কোথা থেকে? মিলনবাবু বলেন, “ছোটবেলায় একবার স্কুলের খেলা দেখতে গিয়েছিলাম। দৌড় প্রতিযোগিতায় এক প্রতিযোগী হঠাত্ অসুস্থ হয়ে পড়ে। বন্ধুরা মিলে তাকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাই। তখন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বাইরে স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক এ ভাবেই দুঃসময়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে বলেছিলেন। তখন থেকেই কারও বিপদ দেখলে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি।”
পেশায় ইলেকট্রিক মিত্রি মিলন বড়জোড়া বিদ্যুত্ সঙ্ঘের সদস্য। ওই ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, কয়েক বছর আগে রাতে কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে মিলন বড়জোড়ার সয়েরগ্রাম এলাকায় এক যুবকের আর্ত চিত্কার শুনতে পান। কাছে গিয়ে দেখেন রক্তাক্ত অবস্থায় হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছেন এক যুবক। মিলনবাবু ওই জখম যুবককে সাইকেলের পিছনে বসিয়ে বড়জোড়া ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান। সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে প্রথমে তাঁকে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও পরে সেখান থেকে দুর্গাপুরের একটি নার্সিংহোমেও নিয়ে যান তিনিই।
মাসখানেক আগে বড়জোড়ায় একটি মোটরবাইকের সামনে পড়ে যায় একটি শিশু। ঘটনাটি দেখে ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপ দিয়ে বাচ্চাটিকে মোটরবাইকের সামনে থেকে সরিয়ে দেন মিলন। বড়জোড়া ব্লক ব্লাড ডোনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গেও যুক্ত মিলন। কারও রক্তের দরকার পড়লেই কাজ ফেলে সেখানে ছুটে যান তিনি। এ ভাবে কতজনকে রক্ত দিয়েছেন তার কোনও হিসেবই নেই মিলনের কাছে।
মিলনবাবুর স্ত্রী মৌসুমী বলেন, “এ জন্য সবাই ওকে সম্মান করে। এটাই আমার গর্ব।” |