সঙ্গিনী নেই, জীবন তাই প্রেমহীন!
নিঃসঙ্গতার কারণেই পশ্চিম মেদিনীপুরের বনাঞ্চলে একটি রেসিডেন্সিয়াল হাতি অস্বাভাবিক আচরণ করছে বলে মনে করছে বন দফতর। ইতিমধ্যে গত তিন দিনে খড়্গপুর ও ঝাড়গ্রামে পৃথক তিনটি ঘটনায় ওই পুরুষ দাঁতাল হাতিটির হামলায় তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। বন দফতর সূত্রের খবর, হাতিটিকে প্রাথমিক ভাবে পর্যবেক্ষণ করে ও স্থানীয় ভাবে তথ্য সংগ্রহের পরে মনে করা হচ্ছে হাতিটি উন্মত্ত। ঝাড়গ্রামের ডিএফও আশিসকুমার সামন্ত বলেন, “মনে হচ্ছে নিঃসঙ্গতার কারণে হাতিটি উন্মত্ত আচরণ করছে। হাতিটির খুনি স্বভাব দেখে কিছুটা সন্দেহও হচ্ছে। হাতিটি সম্পর্কে বিস্তারিত অনুসন্ধান করা হচ্ছে।” খড়্গপুরের ডিএফও অঞ্জন গুহ বলেন, “অধিকাংশ ক্ষেত্রে সঙ্গিনীর দখল নিতে ব্যর্থ পুরুষ হাতি দল থেকে বিতাড়িত হয়ে গিয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। তখন হাতিটি খুনি হয়ে যেতে পারে। আবার পুরনো মানসিক কোনও যন্ত্রণা বা আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণেও হাতি অস্বাভাবিক আচরণ করতে পারে।” বন দফতরের তথ্য বলছে, বছর চারেক আগে সঙ্গিনীর অভাবে এমনই একটি ক্ষিপ্ত হাতি গোপীবল্লভপুর ও নয়াগ্রামে কয়েকদিনের ব্যবধানে ৭ জনকে মেরে ফেলেছিল। ২০১০ সালে ওই হাতিটিকে ‘রোগ’ ঘোষণা করে নয়াগ্রামের রাঙ্গিয়ামের জঙ্গলে গুলি করে মারা হয়েছিল।
কেন রেসিডেন্সিয়াল হাতিটির সঙ্গিনীর অভাব হচ্ছে? বন দফতরের তথ্য বলছে, দলমার পালের দলছুট যে সব পুরুষ হাতি এলাকায় থেকে যায় সেগুলিকেই রেসিডেন্সিয়াল হাতি বলা হয়। সাধারণত, যৌনতার সময় সঙ্গিনীর দখল নিতে ব্যর্থ হলে কিংবা গুণ্ডামি করলে সেই পুরুষ হাতিকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এই দলছুটেরা আর দলমায় ফেরে না। তবে দলছুট রেসিডেন্সিয়াল হাতিদের মধ্যে দলে ফেরার অথবা অন্য দল ভাঙিয়ে পৃথক দল তৈরি করার প্রবণতা থাকে। এলাকায় দলমার পাল এলে ওই রেসিডেন্সিয়াল হাতিরা দলমার পালের স্ত্রী হাতির কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করে। বলা বাহুল্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা ব্যর্থ হয়। ফলে তাদের আর ঘরে ফেরা হয় না। ২০১০ সালে শেষ হাতিসুমারি অনুযায়ী, পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলে ১৭টি রেসিডেন্সিয়াল হাতি ছিল। এখন সংখ্যাটা আরও বেড়েছে। গত বছর ডিসেম্বরে দলমার হাতির পাল এলাকায় থাকার সময় ওই রেসিডেন্সিয়াল হাতিটি দলমার পালের কাছাকাছি এসেছিল বলে মনে করছেন বনকর্মীদের একাংশ। ওই সময় হাতিটি ফের প্রত্যাখ্যত হয়ে থাকতে পারে। দলমার হাতির পাল এখন এলাকায় নেই। ফলে, এলাকায় এখন স্ত্রী হাতিও নেই। বসন্তোসমাগমে নিঃসঙ্গ হাতিটির মানসিক অস্থিরতাই তাকে আরও ক্ষিপ্ত করে তুলেছে।
ওই রেসিডেন্সিয়াল হাতিটির হামলায় বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবারে তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার খড়্গপুরের কলাইকুণ্ডায় জটিয়ার জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে গিয়ে হাতির হামলায় আদিতিরানি মাহাতো নামে এক প্রৌঢ়ার মৃত্যু হয়। শুক্রবার রাতে খড়্গপুর বনবিভাগের অন্তর্গত নয়াগ্রাম ব্লকের জামশোলা গ্রামের জঙ্গল রাস্তায় বাড়ি ফেরার পথে মঙ্গল টুডু নামে এক বনকর্মীকে আছড়ে পিষে মারে হাতি। শনিবার ভোরে ঝাড়গ্রামের ছোটচুয়াশুলি গ্রামে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে হাতির আক্রমণে হীরেন মাহাতো নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়। দলমার হাতি নিয়ে দু’দশক ধরে গবেষণা করে চলেছেন হস্তি বিশেষজ্ঞ অর্ক চৌধুরী। অর্কবাবুর কথায়, সঙ্গিনীর সঙ্গ কামনায় ব্যর্থ হলে কিংবা দীর্ঘদিন স্ত্রী সংসর্গ না করার ফলে নিঃসঙ্গ হাতিটি উন্মত্ত আচরণ করতে পারে। হাতির প্রজননের সময় জুলাই-অগস্ট। তবে বসন্ত সমাগমেও সঙ্গিনীর অভাবে হাতির স্বভাবগত পরিবর্তন হতে পারে।” |