বৃষ্টির মধ্যে মাঝরাতে গ্রামে ঢুকে দফায় দফায় তাণ্ডব চালাল হাতির দল। তাদের হানায় দেওয়াল চাপা পড়ে মারা গেল একটি শিশু। জখম ওই শিশুর মা ও বোন এবং গ্রামের আরও একটি বছর আটেকের শিশু। গ্রামের লোকেরা অ্যাম্বুল্যান্স ও গাড়ির মালিকদের ফোন করলেও হাতির দলের ভয়ে আসতে চায়নি কেউই।
শনিবার রাতে বাঁকুড়ার বড়জোড়ায় মুক্তাতোড় গ্রামের লোহারাপাড়ায় এই ঘটনার জেরে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। তবে, তার চেয়েও বেশি ছড়িয়েছে বন দফতরের বিরুদ্ধে ক্ষোভ। রবিবার সকালে স্থানীয় দেজুড়ি মোড়ে দুর্গাপুর-বাঁকুড়া ৯ নম্বর রাজ্য সড়ক অবরোধ করেন গ্রামবাসীরা। অবরোধ সরাতে এসে বিক্ষোভের মুখে পড়েন বড়জোড়ার তৃণমূল বিধায়ক আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। পুলিশ জানিয়েছে, মৃত শিশুটির নাম আশিস লোহারা (৭)। আশিসের মা পুর্ণিমা লোহারা ও চার বছরের বোন লক্ষ্মী আশঙ্কাজনক অবস্থায় বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি। জখম আর এক পড়শি শিশু আকাশ লোহারাকে বড়জোড়া ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করানো হয়েছে।
বড়জোড়ায় হাতির দাপাদাপি দীর্ঘদিনের সমস্যা। দাঁতাল-বাহিনীর তাণ্ডবে প্রাণহানির পাশাপাশি ফসল ও বাড়িঘরের ক্ষয়ক্ষতি ফি-বছরই ঘটে। প্রতিবাদে বন দফতরের রেঞ্জ ও বিট অফিসে গ্রামবাসীর বিক্ষোভ বা অফিসে তালা লাগিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও আকছারই ঘটে। এলাকার জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলির বাসিন্দাদের অভিযোগ, বন দফতর সব জেনেও কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। হাতির হানায় মানুষের মৃত্যুর ব্যাপারে বড়জোড়ার গদারডিহি এলাকার স্কুলছাত্রী শিল্পী কর্মকার মানবাধিকার কমিশনের দ্বারস্থও হয়েছিলেন। কিন্তু, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। |
স্থানীয় সূত্রের খবর, এক মাসেরও বেশি সময় ধরে দলমার ১৩০টি হাতির দল বড়জোড়া ব্লকের জঙ্গলে রয়েছে। এই দলটিই শনিবার রাতে সাহারজোড়ার জঙ্গল থেকে বেরিয়ে হামলা চালায় লোহারাপাড়ায়। রাত ১২টা নাগাদ হাতিরা গ্রামে ঢুকে সঞ্জয় লোহারার বাড়ির দেওয়াল ভাঙে। দেওয়াল চাপা পড়ে জখম হয় সঞ্জয়বাবুর ছেলে আকাশ। এই ঘটনার আধ ঘণ্টার মধ্যেই পূর্ণিমাদেবীর বাড়িতে হাতির হামলার খবর আসে। সেই সময় বাড়ির মেঝেয় পূর্ণিমাদেবী তাঁর ছেলে, মেয়ে ও স্বামী শঙ্কর লোহারার সঙ্গে ঘুমোচ্ছিলেন। শঙ্করবাবুর কথায়, “হঠাৎই বিকট শব্দে বাড়ির ইটের গাঁথনির দেওয়াল হুড়মুড়িয়ে ধসে পড়ল।” ঘটনাস্থলেই মারা যায় আশিস। জখম হন পূর্ণিমাদেবী ও তাঁর মেয়ে। একটু তফাতে থাকায় অক্ষত শঙ্করবাবু।
তবে, এ দিনও তাঁর চোখেমুখে আতঙ্ক। বললেন, “চোখের সামনে মুখ দিয়ে রক্ত বার করতে করতে নিথর হয়ে গেল ছেলেটা। গ্রামবাসীরা আমার স্ত্রী ও মেয়েকে বার করে নিয়ে গেল। হাতির দল আমার সব শেষ করে দিল!” এ দিন সকাল সাড়ে সাতটা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত পথ অবরোধ করেন ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। তার জেরে গুরুত্বপূর্ণ ওই রাস্তায় যানজট দেখা দেয়। গ্রামবাসীদের দাবি, অবিলম্বে হাতির পালকে বড়জোড়ার জঙ্গল থেকে সরাতে হবে। ওরা ইতিমধ্যেই যে ক্ষতি করেছে, তার দ্রুত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে প্রশাসনকে।
ঘটনায় মৃত, আহত ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলির জন্য বন দফতর ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাস দিলেও এলাকাবাসীর ক্ষোভ কমছে না। অদ্বৈত দে, মলয় মুখোপাধ্যায়, ময়াল বাউরিরা বলেন, “কী ভাবে যে ওই রাতটা আমরা কাটিয়েছি, কথায় তা বোঝাতে পারব না। ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। দেওয়াল চাপা পড়ে আহতেরা চোখের সামনে ছটফট করছে। একের পর এক অ্যাম্বুল্যান্স আর গাড়ির মালিকদের ফোন করেছি। হাতির ভয়ে কেউই গ্রামে আসতে চায়নি। তখন বাধ্য হয়ে গ্রামের ট্রাক্টরে করে হাসপাতালে পাঠাতে হয়েছে।”
হাতির পালটিকে বড়জোড়া থেকে সরিয়ে দলমার পাহাড়ের দিকে পাঠাতে অবশ্য গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকেই ‘সেন্ট্রাল ড্রাইভিং’ শুরু করেছে বন দফতর। ওই অভিযান শুরু হওয়ার এক দিন আগেই বেলিয়াতোড় বন বাংলোয় জনপ্রতিনিধি ও পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করে হাতি খেদাতে দু’পক্ষের সাহায্য চাওয়া হয় বন দফতরের তরফ থেকে। কেন এত দিনে হাতিগুলোকে বড়জোড়া থেকে বের করা গেল না? বাঁকুড়ার ডিএফও (উত্তর) সুধীরচন্দ্র দাস বলেন, “আমরা হাতিগুলিকে তাড়াতে গেলে কিছু গ্রামের বাসিন্দারা পটকা ফাটিয়ে, মশাল বা সার্চলাইট জ্বালিয়ে হাতিগুলিকে ছত্রভঙ্গ করছে। এই বিপত্তির জেরেই মূলত হাতিগুলিকে খেদাতে দেরি হচ্ছে।”
গ্রামবাসীরা যাতে হাতির যাত্রাপথে ব্যাঘাত না ঘটান, তা দেখতে জনপ্রতিনিধিদের সাহায্য চাওয়া হয়েছিল। ডিএফও বলেন, “সহযোগিতা পাচ্ছি। তবে আরও একটু সাহায্য পেলে ভাল হত।” বড়জোড়া পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি কাজল পোড়েল বলেন, “জনপ্রতিনিধিদের ডেকে হাতি খেদানোর সময় বন দফতরকে সাহায্য করার বিষয়ে বৈঠক করব।” বিধায়ক আশুতোষবাবুর কথায়, “হাতির উপদ্রব শুধু বড়জোড়ার সমস্যা নয়। রাজ্য বন দফতরের কর্তাদের এই সমস্যা কাটাতে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে বলেছি।” |