স্বামীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল দু’বছর আগে। তারপর থেকেই নাবালক সন্তানকে নিয়ে কোনও রকমে সংসার চলছে ময়ূরেশ্বরের ল’বেলেড়া গ্রামের গয়ারানি পালের। এর মধ্যে বার কয়েক বিভিন্ন সরকারি সুযোগ-সুবিধার জন্য আবেদন করবেন বলেও ভেবেছেন। কিন্তু যে দফতরেই পৌঁছেছেন, সব জায়গাতেই আগে মৃত স্বামীর ময়না-তদন্তের রিপোর্ট চেয়েছে। অভিযোগ, ওই মহিলা গত দু’বছর ধরে বিভিন্ন দফতরে ঘুরেও পাননি স্বামীর ময়না-তদন্তের সেই রিপোর্টটিই। তা নিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের নানা জায়গায় অভিযোগ জানিয়েও সুরাহা হয়নি। এ বার তাই চিঠি লিখে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরই দ্বারস্থ হতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর আশা, অন্তত মুখ্যমন্ত্রী সাড়া দেবেন।
অভিযোগ, গয়ারানিদেবীর এই অভিজ্ঞতা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। জেলায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ময়না-তদন্তের রিপোর্ট পেতে হয়রান হতে হচ্ছে বলে অনেকেই জানিয়েছেন। বছরের পর বছর দফতর ঘুরেও মৃতের পরিজনেরা ওই রিপোর্ট হাতে পাচ্ছেন না। রাজ্য আইনজীবী সংগঠনের শৃঙ্খলা কমিটির অন্যতম সদস্য রঞ্জিত্ গঙ্গোপাধ্যায় আবার বলছেন, “ময়না-তদন্তের রিপোর্ট না পাওয়ার জন্য বেশ কিছু ক্ষেত্রে মামলা নিষ্পত্তি হতে অনেক দেরি হচ্ছে। আমরা জেলা জজ, মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক, জেলা পুলিশ সুপার প্রমুখদের নিয়ে গঠিত মনিটারিং কমিটির বৈঠকে এ ব্যাপারে সমস্যা সমাধানের জন্য বলেছি। কিন্তু তবুও সমস্যাটা থেকেই গিয়েছে।”
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১১ সালের ১৭ নভেম্বর গয়ারানিদেবীর পেশায় ট্রাক্টর চালক স্বামী স্বপন পালের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। তদন্তের পরে পুলিশের দাবি, স্বপনবাবু মানসিক অবসাদে কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করেন। পরের দিনই রামপুরহাট হাসপাতালে তাঁর মৃতদেহের ময়না-তদন্ত হয়। কিন্তু ওই মহিলা নির্দিষ্ট জায়গায় আবেদন করলেও ঘটনার দু’ বছর পরেও তিনি স্বামীর ময়না-তদন্তের রিপোর্ট পাননি বলে অভিযোগ। ঘটনার কথা শুনে জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনার প্রতিক্রিয়া, “এমনটা হওয়ার কথা নয়। নিয়ম মেনে আবেদন করলে নির্ধারিত সময়ে মধ্যে ময়না-তদন্তের রিপোর্ট হাতে পাওয়ার কথা। কেন ওই মহিলা তা এতদিনেও পাননি, তা বুঝতে পারছি না। লিখিত ভাবে আমার কাছে আবেদন করলে আমি জেলা পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেব।”
সরকারি নিয়মানুযায়ী, আদালতে মামলার ক্ষেত্রে পুলিশ সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল থেকে ময়না-তদন্তের রিপোর্ট সংগ্রহ করে দাখিল করে। ওই রিপোর্ট পাওয়ার জন্য মৃতের পরিবারকে স্থানীয় ট্রেজারিতে পাঁচ টাকা জমা দিয়ে জেলা পুলিশ সুপারের কাছে আবেদন করতে হয়। আবেদনের মাস খানেকের মধ্যে সংশ্লিষ্ট থানা থেকে আবেদনকারীর ওই রিপোর্ট পাওয়ার কথা। নিয়ম মোতাবেক ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে স্বামীর ময়না-তদন্তের রিপোর্ট নেওয়ার জন্য সিউড়ি ট্রেজারিতে টাকা জমা দেন গয়ারানিদেবী। কিন্তু আজও সেই রিপোর্ট তিনি হাতে পাননি। গত সেপ্টেম্বর মাসেই তিনি তত্কালীন পুলিশ সুপারকে এ নিয়ে একটি লিখিত অভিযোগ জানিয়েছিলেন। তাঁর অভিযোগ, “তারপরেও কোনও কাজ হয়নি। এই অবস্থায় নাবালক সন্তানকে নিয়ে পরের উপর নির্ভর করে দিন কাটছে। এসপি-র দফতরে খোঁজ নিতে গেলে আমাকে জানানো হয়, রিপোর্ট থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার থানায় গেলে সেখানকার অফিসারেরা কখনও জানান, এসপি-র অফিসে খোঁজ নিন। আবার কখনও জানান, যে চিকিত্সক ময়না-তদন্ত করেছেন, তাঁর কাছে যান। অর্থের অপচয় তো হচ্ছেই, উল্টে সরকারি সাহায্যও পাচ্ছি না।” একই গ্রামের তৃণমূল কর্মী সুনীল পালও বলছেন, “ওই মহিলাকে নিয়ে প্রশাসনের পাশাপাশি দলীয় নেতাদের কাছে গিয়েছি। কিন্তু ময়না-তদন্তের রিপোর্ট তিনি পাননি। মাঝখান থেকে অনর্থক হয়রানি এবং তাঁর কষ্ট করে জোগাড় করা টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে।” এই পরিস্থিতিতে ওই মহিলা বলছেন, “এক দিকে স্বামীর মৃত্যুর জন্য বিমা সংক্রান্ত টাকার পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারছি না। একই ভাবে সরকারি সহায়তার জন্যও আবেদন করতে পারছি না।”
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে (বিশেষত দুর্ঘটনাজনিত) যেমন বজ্রাঘাত, সাপে ছোবল মারা-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা সরকারি সহায়তা এবং বিমার টাকা পাওয়ার ক্ষেত্রে ময়না-তদন্তের রিপোর্ট আবশ্যক। আবার ওই জাতীয় মৃত্যু সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তির জন্যও আদালতে ময়না-তদন্তের রিপোর্ট দাখিল করতে হয়। কিন্তু গয়ারানিদেবীর মতো এই জেলার অনেকেই নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরেও নিজেদের মৃত পরিজনদের ময়না তদন্তের রিপোর্ট পাচ্ছেন না বলেই অভিযোগ।
এ নিয়ে যোগাযোগ করা হলে জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক কার্তিকচন্দ্র মণ্ডলের দাবি, তাঁর কাছে এমন কোনও অভিযোগ আসেনি। অবশ্য তিনি বলেন, “কোনও ব্যক্তি সরাসরি আমাদের কাছ থেকে রিপোর্ট পেতে পারেন না। পুলিশকে আমরা যথা সময়ে রিপোর্ট দিয়ে থাকি। তবু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখব।” ওই ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধেই সব বেশি অভিযোগ। যদিও জেলার বর্তমান পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া বলেন, “এমনটা হওয়ার কথা নয়। কেউ ট্রেজারিতে টাকা জমা দিয়ে আবেদন করলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই ময়না-তদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার কথা। ওই মহিলার ক্ষেত্রে কী হয়েছে, খোঁজ না নিয়ে বলতে পারব না। লিখিত অভিযোগ পেলে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেব।” |