বিশ্বখ্যাত পরিচালকদের পছন্দের চিত্রগ্রাহকের তালিকায় তিনি দীর্ঘদিন ছিলেন প্রথম সারিতে। ডগলাস স্লোকোম্বে। দীর্ঘ ৪৭ বছরের কেরিয়ারে বানিয়েছেন ‘কাইন্ড হার্টস অ্যান্ড করোনেটস’, ‘দ্য ম্যান ইন হোয়াইট স্যুট’, ‘দ্য ল্যাভেন্ডার হিল মব’-এর মতো একাধিক ক্লাসিক। স্পিলবার্গের বিখ্যাত ইন্ডিয়ানা জোন্স-সিরিজের ক্যামেরাও
|
ডগলাস স্লোকোম্বে |
তাঁরই করা। অস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন তিন-তিন বার।
অথচ স্লোকোম্বে-র বাঁচারই কথা ছিল না প্রায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার যখন পোল্যান্ড আক্রমণ করেন, স্লোকোম্বে তখন সেখানে। ক্যামেরা নিয়ে বিশ্বযুদ্ধের ছবি তুলতে ব্যস্ত। কী ভাবে অবিশ্রান্ত বোমাবর্ষণের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছিলেন, সেটাই হতে পারে একটা আস্ত সিনেমা।
সেটা ১৯৩৯ সাল। স্লোকোম্বে তখন বছর ছাব্বিশ-সাতাশের যুবক। ছোটখাটো পত্র-পত্রিকার জন্য ছবি তুলে বেড়াচ্ছেন। হঠাৎই এক দিন কাগজে শিরোনাম বেরোল “ডানজিগ, ডেঞ্জার পয়েন্ট অব ইউরোপ”। ব্যাগ-পত্তর গুছিয়ে, লাইকা ক্যামেরা কাঁধে ঝুলিয়ে ঘর ছাড়লেন। গন্তব্য ‘ডেঞ্জার পয়েন্ট’।
বাল্টিক সাগরের ধারে ছোট্ট শহর ডানজিগ। দু’ধারে জার্মান সাম্রাজ্য। আর পেছন দিকে পোল্যান্ড। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লিগ অব নেশনস্ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এই বন্দর শহরকে স্বশাসনের অধিকার দেওয়া হবে। কিন্তু ৩০-এর দশকে জার্মানির ক্ষমতা চলে গিয়েছে ফ্যুয়েরার হিটলারের হাতে। আর ডানজিগেও সে সময় রীতিমতো সক্রিয় স্থানীয় নাৎসিরা। স্লোকোম্বে যখন ডানজিগে পৌঁছলেন তখন নাৎসি আক্রমণের গুঞ্জন আকাশে-বাতাসে। ইহুদিদের উপর আক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছে। ফুটপাথে টহল দিচ্ছে ব্রাউন-শার্টস বাহিনী। তাদের মোজার মধ্যে লুকনো ধারালো ছুরি।
এক দিনের কথা ডগলাসের মনে আছে। প্রচুর মানুষ জড়ো হয়েছেন রাস্তায়। আর সেখানে বক্তৃতা দিচ্ছেন স্থানীয় নাৎসি নেতা আলবার্ট ফরস্টের। নিজের লাইকা ক্যামেরায় ধরে রেখেছিলেন সেই মুহূর্ত। আর একটা দিন, কেউ বা কারা ইহুদিদের প্রার্থনা-সভার সামনে একটা বড় স্বস্তিক চিহ্ন আঁকা পতাকা ঝুলিয়ে দিয়েছিল। ক’দিন এ রকম কাটতে না কাটতেই স্লোকোম্বে বুঝতে পারেন, তাঁর উপর নজর রাখা হচ্ছে। ঠিক করেন, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসবেন।
কিন্তু তখনই ডাক আসে মার্কিন পরিচালক হারবার্ট ক্লাইনের কাছ থেকে। ইউরোপে যে যুদ্ধের দামামা বেজে গিয়েছে, তা নিয়ে একটা তথ্যচিত্র বানাচ্ছিলেন তিনি। ব্রিটেনের জন্য ক্যামেরাম্যান তত দিনে ঠিক করে ফেলেছেন ক্লাইন। কিন্তু পোল্যান্ডের ছবি তোলার লোক তাঁর হাতে নেই। ডগলাসকে তিনি বলেন, ডানজিগে থাকলে তাঁকে মুভি ক্যামেরা দিতে রাজি হারবার্ট।
বেল অ্যান্ড হওয়েলে ৩৫এমএম আইমো ক্যামেরা। যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি তোলা বা নিউজরিলের জন্য তখন সারা বিশ্বের এক নম্বর পছন্দ। ক্যামেরার লোভটা এড়াতে পারলাম না, প্রস্তাবটা নিয়েই নিলাম স্বীকারোক্তি স্লোকোম্বের।
ক্যামেরাটা ছিল বেশ ভারী। আর মাঝে মাঝে অদ্ভুত শব্দও হতো। এক বার অডিটোরিয়ামে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন হিটলারের প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী গোয়েবলস। ক্যামেরা নিয়ে যথারীতি হাজির তরুণ স্লোকোম্বে। গোয়েবলসের কথার মাঝে আচমকাই ঘর ঘর করে শব্দ করে ওঠে ডগলাসের ক্যামেরা। হতভম্ব গোয়েবলস কী করবেন বুঝতে না পেরে থেমে গিয়েছেন। আর তাঁর রক্ষীরা কটমট করে তাকিয়ে দেখছেন ডগলাসকে।
এর পর এক দিন গেস্টাপোর হাতে বন্দি হন স্লোকোম্বে। পর দিন সকালে ছেড়েও দেওয়া হয় তাঁকে। শহরের পোলিশ কর্তৃপক্ষ তাঁর ক্যামেরাটাকে ছাড়ানোর বন্দোবস্তও করে দেন। ১৯৩৯-এর অগস্ট মাস সেটা। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ডানজিগ থেকে ২০০ মাইল দূরে ওয়ারশতে চলে যান স্লোকোম্বে। নাৎসিদের নজর এড়িয়ে যোগাযোগ করেন পরিচালক ক্লাইনের সঙ্গে। তাঁকে নজরে রাখার লোক লাগানো থেকে গারদে রাত্রিবাস, সব কথাই খুলে বলেন তাঁকে।
ডগলাসকে ফিরে আসতে না বলে উল্টে তাঁর কাছে চলে যান ক্লাইন নিজেই। সেপ্টেম্বরের প্রথম দিন। প্রবল শব্দে তাঁদের ঘুম ভেঙে যায় ভোর পাঁচটাতেই। মাথার উপর চক্কর কাটছে বোমারু বিমান। স্লোকোম্বের কথায়, “ভেবেছিলাম সুড়ঙ্গের মধ্যে যুদ্ধ আটকে থাকবে। ওই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো। কিন্তু চারিদিক ঘিরে ফেলা যে কী জিনিস সে দিন বুঝেছিলাম।”
পোল্যান্ডের সেনাবাহিনীর সঙ্গে ছবি তুলবেন বলে দু’জনে এলেন টোরুনে। জার্মানি যে ভাবে সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করেছে তাতে পোল্যান্ডের জেতার সম্ভাবনা নেই, বুঝতে পেরেছিলেন সকলেই। ক্লাইন-ডগলাস জুটি রওনা হন আরও দক্ষিণে। তাঁদের ট্রেন যখন মাঝরাস্তায়, মাথার উপর জড়ো হয় জার্মান বিমান। কাছেই বোমা ফেলে তারা। নাগাড়ে চলে মেশিনগান থেকে গুলিবর্ষণ। চোখের সামনেই মারা যায় একটি বাচ্চা মেয়ে।
একটা গরুর গাড়ি কেনেন স্লোকোম্বেরা। ক্যানভর্তি ফিল্ম তাতে চাপিয়ে আবার শুরু হয় যাত্রা। প্রায় তিন দিন চলার পর একটা রেলস্টেশন। ট্রেন ধরে পৌঁছন লাতভিয়া। সেখানে ব্রিটিশ কনসুলেটের সবাই তখন ব্যাগপত্তর গুছিয়ে দেশে ফিরছেন। শেষমেশ নাৎসিদের চোখে ধুলো দিয়ে কোনও রকমে স্টকহলমে পৌঁছন ক্লাইনরা। পরের বছর ১৯৪০-এ বেরোয় তাঁদের তথ্যচিত্র লাইটস আউট ইন ইউরোপ। এখন কেবল তার একটা প্রিন্টই রয়ে গিয়েছে নিউ ইয়র্কে। তবে তার অবস্থাও বিশেষ ভাল নয়।
কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারের নেশাটা আবার ক’দিনের মধ্যেই বাড়ি থেকে টেনে বার করে ডগলাস স্লোকোম্বেকে। ডগলাস আর তাঁর আইমো পৌঁছে যায় আমস্টারডাম। জার্মান আক্রমণের মুখে প্রাণ হাতে নিয়ে পালান আবার।
শতায়ু স্লোকোম্বে এখন থাকেন টেমস পাড়ের একটা বাড়িতে। হারাতে বসেছেন দৃষ্টিশক্তি। সম্বল বলতে মহার্ঘ্য স্মৃতিটুকুই। |