চুপি চুপি শত্রু ঘাঁটিতে ঢুকে বোমা ফেলে আসছে বিমান, এমন তো কতই শোনা যায়। কিন্তু বোমার বদলে যদি থাকে এক ঝাঁক মশা! গুলি-বোমা-গ্রেনেডের পাল্টা হাতিয়ার পালে পালে মশার কামড়। এক বার হুল ফোটালেই নির্ঘাৎ ম্যালেরিয়া। নাৎসি জার্মানি এমনই অভিনব পরিকল্পনা করেছিল বলে সম্প্রতি দাবি করলেন এক গবেষক। একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সেই গবেষণাপত্রটি।
তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে পুরোদমে। শত্রুপক্ষকে কাবু করতে নিত্য নতুন আবিষ্কারের ফন্দি আঁটছে হিটলারের জার্মানি। এক দিকে রাসায়নিক বোমা বানানোর ফর্মুলা নিয়ে মেতেছেন এক দল বৈজ্ঞানিক। সঙ্গে চলছে কীট-পতঙ্গ নিয়ে গবেষণাও। এ জন্য গবেষণাগারও তৈরি করেছিল নাৎসি বাহিনীর সামরিক-শাখা বাফেন-এসএস।
দেশের সামরিক বাহিনী কেন হঠাৎ এই সব পতঙ্গ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, তা নিয়েই গবেষণা করছিলেন টুবিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর ক্লাউস রাইনহার্ট। সে সময়ের ইতিহাস খতিয়ে দেখে ক্লাউস জানতে পারেন, কীট-পতঙ্গের উপর পরীক্ষা চালাতে তখন জার্মানিতে একাধিক গবেষণাগার ছিল। শাক-সব্জি বা খাবার জিনিসে এরা কী ক্ষতি করে বা তা থেকে বাঁচার উপায়টাই বা কী, এ নিয়ে চিরাচরিত গবেষণার পথ কিন্তু মাড়ায়নি সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন এই গবেষণা কেন্দ্রটি। তা ছাড়া, এর অবস্থানটাও চিন্তায় ফেলেছিল ক্লাউসকে। আর সব জায়গা বাদ দিয়ে নাৎসিরা কেন কুখ্যাত ডাচাও কনসেনট্রেশন ক্যাম্প চত্বরই বেছে নিয়েছিল, সেই প্রশ্নের উত্তরও খুঁজছিলেন রাইনহার্ট।
গবেষণাগারের বিভিন্ন নথিপত্র ঘেঁটে ক্লাউস দেখেন, পতঙ্গবাহী রোগ যেমন টাইফয়েডের প্রতিষেধক নিয়ে সেখানে গবেষণা চলছিল তেমনই মশা নিয়েও এখানকার বিজ্ঞানীদের মধ্যে ছিল প্রবল উৎসাহ। ক্লাউসের দাবি, কেবল রাসায়নিক যুদ্ধের গণ্ডিতে বিশ্বযুদ্ধকে বেঁধে না রেখে কী ভাবে তাকে জৈব-যুদ্ধে পরিণত করা যায় আসলে এখানে তলে তলে সেই চেষ্টাই হচ্ছিল।
জৈব অস্ত্র ব্যবহার করে লড়াইয়ে মত ছিল না হিটলারের। তবু নাৎসি জার্মানিতে সে কালে এমন মারণাস্ত্র তৈরির একটা চেষ্টা চলছিল বলে বহু দিন ধরেই দাবি করে আসছেন এক দল গবেষক। ক্লাউস রাইনহার্টের আবিষ্কার নতুন করে উস্কে দিল সেই বিতর্ক।
১৯৪২ সালে বাফেন এসএস-এর গবেষণাগারটির দায়িত্ব নেন হেনরিক হিমলার। সে সময় দু’টি ঘটনায় এই পতঙ্গ-চর্চার গুরুত্ব বেড়ে যায় হঠাৎই। নাৎসি হানা-বাহিনীর মধ্যে উকুনের প্রকোপ দেখা দিয়েছিল ভীষণ ভাবে। সেই সঙ্গে নয়েনগমে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে হানা দিয়েছিল টাইফয়েড। এই সাঁড়াশি আক্রমণ ঠেকাতে শেষমেশ এ নিয়ে বিশেষ সার্কুলার অব্দি জারি করতে হয়েছিল হিমলারকে। ক্লাউস রাইনহার্টের দাবি, এর ঠিক দু’বছরের মাথায় গবেষণার যাবতীয় আলো গিয়ে পড়ে মশাদের উপর।
১৯৪৪ সাল নাগাদ সংস্থাটির অধিকর্তা ছিলেন এডুয়ার্ড মে। তাঁদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার একাধিক রিপোর্ট হাতে এসেছে ক্লাউসের। রাইনহার্টের কথায়, অ্যানোফিলিস মশাদের নিয়ে বিস্তর গবেষণার উল্লেখ রয়েছে সেই রিপোর্টে। একটি রিপোর্টে মে আলাদা করে উল্লেখ করেছেন, এক বিশেষ প্রজাতির অ্যানোফিলিস মশা প্রতিকূল পরিবেশে তিন-চার দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। শত্রু ডেরায় ম্যালেরিয়া ছড়ানোর একটা যে গোপন চক্রান্ত চলছিল, এটা তার সরাসরি ইঙ্গিত বলেই মনে করেন ক্লাউস।
কেন হঠাৎ ডাচাও কনসেনট্রেশন ক্যাম্পকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল, রাইনহার্ট তাঁর গবেষণাপত্রে তারও একটা জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাঁর মতে, এই সদ্য আবিষ্কৃত জৈব অস্ত্র কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ইহুদিদের উপর প্রয়োগ করা যেত সহজেই। অধ্যাপক শিলিং এখানে ম্যালেরিয়ার প্রভাব পরীক্ষাও করেছিলেন বলে দাবি তাঁর। পরে ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হয়েছিল খোদ শিলিংকেই। যদিও গবেষণা কেন্দ্রের অধিকর্তা এডুয়ার্ড মে’র সঙ্গে শিলিংয়ের যোগাযোগ হয়েছিল, এমন প্রত্যক্ষ প্রমাণ অবশ্য হাজির করতে পারেননি ক্লাউস। |