গোলপোস্টের গায়ে চুমু খেয়েই গ্যালারির দিকে উর্ধ্বশ্বাস দৌড়। চোখের কোনে জল, আকাশের দিকে তাকিয়ে গর্জন। দেড় বছরের যন্ত্রণা ও অপমানের জ্বালা বোধহয় এ ভাবেই মেটালেন নাসিম আখতার!
দেড় বছর ধরে যে ক্যামেরার লেন্সগুলো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, শনিবাসরীয় সন্ধ্যায় সেই লেন্সগুলোই ছুটছে কসবার সেই গোলকিপারকে লক্ষ্য করে। আবার আলোর জগতে তিনি। সমর্থকদের নয়নের নতুন মণি। কেউ জড়িয়ে তাঁকে ধরে কাঁদছেন, কেউ পায়ে লুটিয়ে পড়ছেন। তবু যন্ত্রণা ও অপমানের দিনগুলোকে কিছুতেই ভুলতে পারছেন না নাসিম আখতার।
নইলে স্মৃতির সরণিতে ফেলে আসা সাড়ে পাঁচশো দিনের হিসেব দিতে গিয়ে মহমেডান গোলকিপার কেন বলে উঠলেন, “দুঃসময়ে চেনা যায় মানুষকে। তবে আমি কৃতজ্ঞ মহমেডান ক্লাবের কোচ এবং কর্তাদের কাছে, যারা আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছেন। এই ঋণ কোনও দিন শোধ করতে পারব না।” |
জনসমুদ্রে। শিল্ডের নায়ক নাসিম আখতার। |
মহমেডান তাঁকে ফুটবলে নতুন জীবন দিলেও, শিল্ড জয়ের আনন্দ নিজের মা এবং তাঁর হবু স্ত্রীকে উৎসর্গ করলেন নাসিম। শনিবার মহমেডান ড্রেসিংরুমের সামনে দাঁড়িয়ে সাদা-কালো গোলকিপার বললেন, “আমার মা বেনারসে আমার জন্য প্রার্থনা করছেন। মায়ের আশীর্বাদ না থাকলে এই কঠিন সময়ে লড়তে পারতাম না। মা বলেছিলেন, মরার আগে মরবি না। টাইব্রেকারে দিদারুল যখন শেষ কিকটা মারছে, তখন মা-কেই মনে করেছিলাম।” তবে সবচেয়ে আনন্দের খবর হল, শিল্ডের পরেই নিকাহ করবেন বলে জানালেন নাসিম। পাত্রীও ঠিক। লখনউয়ের মেয়ে। পেশায় শিক্ষিকা। নাসিম বলছিলেন, “এখনও দেখিনি মেয়েকে। মা ঠিক করে রেখেছেন। এপ্রিলে বিয়ে। কিন্তু ভেবেছি, কিছু দিন ছুটি নিয়ে আগেই দেখা করে আসব। শিল্ডের মেডেলটা ওকে উপহার দিতে চাই।”
টাইব্রেকারের নায়ক নাসিম হলে নির্ধারিত সময়ে নায়ক মেহরাজউদ্দিন। শুরুতে পিছিয়ে পড়া দলকে শুধু সমতায় ফেরালেন না, টাইব্রেকারেও মহমেডানকে দিশা দেখালেন কাশ্মীরী ডিফেন্ডার। যোগ্য ফুটবলার হিসেবে ম্যাচের সেরা বাছা হল তাঁকে। মেহরাজ অবশ্য তাঁর সেরার ট্রফিটা দশ মাসের পুত্র মহম্মদ আমেদকে উৎসর্গ করলেন। ড্রেসিংরুমের ভিতরে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, “এই দশ মাসে একটাও ট্রফি পাইনি। বাড়িতে ঢুকেই ছেলের হাতে ট্রফিটা ধরিয়ে দেব। জানি, ও হয়তো বুঝবে না। কিন্তু ওর জন্যই তো এটা সম্ভব হল!” |
যুবভারতীর আনাচে কানাচে শনিবারের সব আলো তখন হন্তদন্ত হয়ে খুঁজে চলেছে দুই নায়ককে। নাসিম-মেহরাজের এক ঝলক পাওয়ার জন্য ড্রেসিংরুমের সামনে সাদা-কালো সমর্থকদের বিশাল ভিড়। পুলিশি পাহারা তো বটেই, কর্তারাও ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খেয়ে গেলেন। এরই ফাঁকে আইএফএ শিল্ডটা কাঁধে করে মাঠ থেকে ড্রেসিংরুম পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন সাদা-কালো সমর্থকরা। মুখে অনবরত জয়ধ্বনি, “নাসিমভাই জিন্দাবাদ, মেহরাজভাই জিন্দাবাদ...।” সমর্থকদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস দেখে হতবাক সাদা-কালোর বিদেশি ফুটবলাররাও। পেন বলছিলেন, “ইস্টবেঙ্গলে এ রকম উন্মাদনা দেখেছি। মহমেডানেও যে এ রকম হবে, ভাবতে পারিনি।” দু’হাত দূরেই দাঁড়িয়ে থাকা লুসিয়ানো আবার বললেন, “গোয়া ছেড়ে কলকাতায় এসেছিলাম এই উন্মাদনার জন্য। মহমেডানে এত দিন খেলার পরে সেটা দেখতে পেলাম।”
হবে না-ই বা কেন? তেতাল্লিশ বছর পরে শিল্ডের পদধুলি পড়ল মহমেডান তাঁবুতে। তেতাল্লিশ বছর পরে ফের যুবভারতীর রং লাল-হলুদ নয়। সবুজ-মেরুন নয়। সাদা-কালো।
দীর্ঘ যন্ত্রণা, অপমানের শোধ তোলার উন্মাদনা-উচ্ছ্বাসের ছবি তো চিরকালই অন্য রকম হয়! |
রেফারির বিরুদ্ধে ক্ষোভে শিল্ডের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান বয়কট করল ধানমন্ডি। ম্যাচের পরে সাংবাদিক সম্মেলনেও আসেননি ধানমন্ডির কেউ। আইএফএ সচিব উৎপল গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, “ওদের সঙ্গে কথা হয়েছে। পুরোটাই একটা ভুল বোঝাবুঝি। ওরা বলল, ওরা বুঝতে পারেনি।” |