৪৩ বছর পরে শিল্ড মহমেডানের
নাসিমকে নামিয়েই বাজিমাত সঞ্জয়ের

ধানমন্ডি, বাংলাদেশ: ১ (৩) (সনি)
মহমেডান: ১ (৪) (মেহরাজ)
তিয়াত্তর বছর পর ডুরান্ড কাপ!
তেতাল্লিশ বছর পর আইএফএ শিল্ড!
বাংলার কোনও ক্লাব দলের তো নয়ই, ভারতীয় ফুটবলেও কোনও ক্লাবের এ রকম ফিনিক্স পাখির মতো পুনরুত্থানের ইতিহাস নেই মহমেডান যা করে ফেলল শনিবার, যুবভারতীতে।
আশির দশকের পর রেড রোডের পাশে অন্ধকারে চলে যাওয়া ক্লাবে আবার রোদ! সূর্যের উত্তাপ!
কতদিন পর আবার মহমেডান দ্বিমুকুট জিতল? পরিসংখ্যানবিদরা মাথা চুলকোচ্ছেন!
ধানমন্ডির দিদারুল হকের সাডেন ডেথের শটটা মহমেডান কিপার নাসিম রুখে দিতেই দেখা গেল প্রেসবক্সে বসে থাকা শান্ত স্বভাবের সৈয়দ নইমুদ্দিনও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। চোখের কোনে জল। মাঠে উপস্থিত তেতাল্লিশ বছর আগের শিল্ড জয়ী দলের একমাত্র ফুটবলার। “দারুণ অভিজ্ঞতা। কিছুদিন আগেও কল্পনা করতে পারিনি, জীবদ্দশায় এই দৃশ্যটা কোনওদিন দেখে যেতে পারব। মহমেডানকে তো সবাই হিসেবের বাইরেই রেখে দিয়েছিল।” বেশ আবেগপ্রবণ দেখাচ্ছিল ফুটবল দ্রোণাচার্যকে।

আইএফএ শিল্ড নিয়ে।
ফেন্সিং টপকে পাগলের মতো পিলপিল করে ঢুকছিলেন হাজার হাজার মহমেডান সমর্থক। লাগামহীন তাঁরা। কেউ দৌড়চ্ছেন। কেউ নাচছেন। কেউ শুধুই লাফিয়ে যাচ্ছেন। কেউ আবার সেন্টার সার্কেলের ভিতর হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা করছেন। তাঁদের কারও হাতে সাদা-কালো পতাকা। কারও হাতে শুধুই জাতীয় পতাকা। দেশের সঙ্গে ক্লাব বাংলাদেশের ক্লাবের বিরুদ্ধে জেতার মরিয়া চেষ্টায় এটাই তো ছিল সেরা প্রেরণা! পেন-ধনরাজ-নির্মলরা প্রস্তুত হচ্ছিলেন ভিকট্রি ল্যাপ দেওয়ার জন্য। কিছুটা এগোচ্ছিলেনও। কিন্তু পারলেন কই!
সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো, বন্যার জলের মতো ধেয়ে আসা উচ্ছ্বাস দেখে ভয়ে উল্টো দিকে দৌড়তে শুরু করলেন। রিজার্ভ বেঞ্চে পৌঁছে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। তখনই ফুটবলারদের বাঁচাতে দফায় দফায় লাঠি চালাতে শুরু করল পুলিশ। কিন্তু তাতেও থামানো যাচ্ছিল না মহমেডান সমর্থকদের। সবাই একবার ফুটবলারদের গা ছুঁয়ে দেখতে চান। একটা সময় মনে হচ্ছিল ট্রফিটাই না হাইজ্যাক হয়ে যায়!
বহুদিন পর ঘরের মাঠে ট্রফি জয়। কলকাতার সবথেকে আবেগপ্রবণ সমর্থকদের উচ্ছাস থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু ম্যাচটা যে তীব্রতা এবং উত্তেজনা তৈরি করে শেষ হল, বলতে দ্বিধা নেই, তা হৃদয়ে দোলা দেওয়ার মতোই। ধানমন্ডির সনি নর্ডির ফ্রিকিকে দুর্দান্ত সোয়াভির্ং গোল। বিরতির আগেই মেহরাজের গোলে মহমেডানের সমতায় ফেরা। নির্ধারিত সময়ের ম্যাচ শেষ হওয়ার আট মিনিট আগে জোড়া লালকার্ড। নিজেদের মধ্যে মারামারি করে ধানমন্ডির সেরা বিদেশি সনি নর্ডি এবং মহমেডানের সেরা ডিফেন্ডার লুসিয়ানো সাব্রোসা বেরিয়ে গেলেন কার্ড দেখে। মোট চল্লিশ মিনিট দশ বনাম দশের ধুন্ধুমার লড়াই। ১-১ অবস্থায় টাইব্রেকার এবং শেষ পর্যন্ত সাডেন ডেথে ম্যাচের নিষ্পত্তি। এরকম উত্তেজক মুহূর্ত তো সোপ অপেরাতেই দেখা যায়!

ম্যাচের নায়ক গোলকিপার নাসিম।
তাঁকে জড়িয়ে উচ্ছ্বাস কোচ সঞ্জয়ের।
ময়দানে কোচিং করতে এসে বহু অঘটন ঘটিয়েছেন মহমেডান কোচ সঞ্জয় সেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও জীবনে কখনও ট্রফি জেতেননি। বারবার ফাইনালে উঠেছেন এবং ছিটকে গিয়েছেন। বেশ কয়েকবারই তাঁকে ট্রফি থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে টাইব্রেকার। আর শনিবার শিল্ড ফাইনালে সেই টাইব্রেকারই ট্রফি জয়ের স্বাদ এনে দিল তাঁকে। আবেগপ্রবণ সাদা-কালো কোচ ম্যাচের পর বলছিলেন, “কলকাতার দুই প্রধানকে হারিয়েছে ধানমন্ডি। বাংলাদেশের একটা টিম আমাদেরও হারিয়ে ট্রফি নিয়ে যাবে? এটা তো আর বসে বসে দেখতে পারি না। শিল্ডটা দেশে রাখতে পেরে তাই অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে দেশের জন্যই কিছু করলাম।” চেতলার ভদ্রলোক যেটা বলেননি, তা হল, আর্মান্দো কোলাসো আর করিম বেঞ্চারিফার দল ছিটকে যাওয়ার পর পড়শি দেশের বিরুদ্ধে তিনিও ব্যর্থ হলে হইচই পড়ে যেত বাংলার ফুটবলের আর কিস্যু হবে না। গোল্লায় গিয়েছে। সেই আওয়াজ অন্তত এ দিন রুখে দিলেন তিনি।
পোড় খাওয়া সঞ্জয় আর ধানমন্ডির ছটফটে নাইজিরীয় কোচ যোশেফ আফুসি কয়েকদিন আগেই গ্রুপ লিগে মুখোমুখি হয়েছিলেন। ফলে দু’জনেই জানতেন-ম্যাচটা বের করতে হলে কোন অঙ্কটা কার্যকর করতে হবে।
দু’জনেই চেয়েছিলেন যথাসম্ভব বল দখলে রেখে আক্রমণে যেতে। মহমেডান কোচ যেমন বিপক্ষের নর্ডি-এমেকা-ওয়েডসনকে নিয়ে তৈরি ত্রিফলা আক্রমণ রুখতে চেয়েছিলেন নিজের আঁটোসাঁটো রক্ষণ দিয়ে, তেমনই পেন-নবি-জোসিমারকে আটকাতে জোনাল মার্কিংয়ের আশ্রয় নিয়েছিলেন ধানমন্ডি কোচ। ফলে ম্যাচটা জমে গেল। উপভোগ্যও হল। খেলাটা দুলল পেন্ডুলামের মতো। ম্যাচটা অবশ্য নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই শেষ করে দিতে পারত দু’দলই। কিন্তু পেন, নবি বা এমেকা, ওয়েডসন কেউই সহজতম গোলের সুযোগ কাজে লাগাতে পারেননি।
ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট কী? চৌম্বকে উঠে আসছে তিনটি মুহূর্ত।

নাসিমের সেভের পরে পেনদের জয়োচ্ছ্বাস।
এক) বিরতির মুখেই মেহরাজের ম্যাচ ১-১ করে দেওয়া।
দুই) ধানমন্ডির প্রাণভ্রমরা সনি নর্ডির লালকার্ড দেখে বেরিয়ে যাওয়া।
তিন) অতিরিক্ত সময়ের শেষ মিনিটে কিপার বদল করে লুই ব্যারেটোর জায়গায় নাসিমকে নামিয়ে দেওয়া। “ওটা আমার প্ল্যানিংয়ের মধ্যেই ছিল। ইউনাইটেডে কোচিং করার সময়ও শেষ দিকে গোলকিপার বদল করেছি এবং সফল হয়েছি,” বলছিলেন তৃপ্ত মহমেডান কোচ।
কিন্তু দেড় বছর কার্যত ম্যাচের মধ্যে না থাকা নাসিম আখতারের হাত ধরে সাফল্য আসবে, বোধহয় তা কল্পনাও করেননি সাফল্যের বৃত্তে ঢুকে পড়া সঞ্জয়। উত্তরপ্রদেশের হয়ে সন্তোষ ট্রফিতে না খেলায় নাসিম সাসপেন্ড হয়ে বসেছিলেন বহু দিন। তিন মাস আগে কিপার সমস্যায় ভুগতে থাকা মহমেডান তাকে সই করায় কিছুটা বাধ্য হয়েই। এ দিন মহমেডান কোচ যখন ছ’ফুটের নাসিমকে নামাচ্ছিলেন, তখন প্রেসবক্সে বসে থাকা তার সতীর্থরাও দলের নতুন কিপারকে নিয়ে হাসাহাসি করছিলেন। শেষ পর্যন্ত সেই অন্ত্যজ কিপারের হাতই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে দিল। টাইব্রেকারে নিজের দলের জোসিমার আর রহিম নবির ব্যর্থতা সাদা-কালো কিপার ঢেকে দিলেন ডান ও বাঁ দিকে উড়ে গিয়ে দু’টো দুর্দান্ত সেভ করে।
মহমেডানের পুনর্জন্ম। নাসিমের ‘কিপার জীবন’ ফিরে পাওয়া। সঞ্জয়ের প্রথম ট্রফি জেতা। সাদা-কালোর আকাশে সত্যিই যেন ‘পূর্ণিমার চাঁদ’।

মহমেডান: লুই ব্যারেটো (নাসিম), নির্মল, লুসিয়ানো, মেহরাজ, ধনরাজ, নবি, রাকেশ, মণীশ, ইসফাক (অসীম) (পাইতে), জোসিমার, পেন।

ছবি: উৎপল সরকার।

পুরনো খবর:




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.