পার্লামেন্টারি আদবকায়দার সেকেলে রীতিনীতিতে বড় হয়ে ওঠার ফলে কোনও দিন সাংসদ থাকার সময়ে ‘ওয়েল’-এ নেমে বিক্ষোভে যোগ দিইনি। তেমন প্রতিবাদযোগ্য কিছু ঘটলে অথবা পার্টির নির্দেশ থাকলে প্রথম সারি পর্যন্ত এগিয়ে যেতাম, লক্ষ্মণরেখা পার হতাম না। তেমনই এক বার ফার্স্ট রো-তে দাঁড়িয়ে ছিলাম, মহিলা বিল পেশ নিয়ে তাণ্ডব হয়েছিল সে বার। ওয়েল-এর দিকে ধেয়ে এলেন এক দল মহিলা বিল বিরোধী সাংসদ। হঠাৎ দেখলাম কাঁধ থেকে শালটা উধাও হয়ে গেছে আর এক পায়ে চটি পরে দাঁড়িয়ে আছি। অন্য পাটি গেল কোথায়? তত ক্ষণে ওয়েলে ধস্তাধস্তি চলছে, স্পিকারের টেবিলের কাগজপত্রের ছেঁড়া টুকরো উড়ছে। আইনমন্ত্রীর হাত থেকে বিল কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তিনি অবশ্য উচ্চস্বরে ঘোষণা করেছেন: আমি বিল পেশ করলাম। ও দিকে যুদ্ধরত সাংসদদের দ্বারা ওয়েলের মধ্যে পরিবেষ্টিত হয়ে পড়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বার যে কাণ্ড প্রত্যক্ষ করলাম, তুলনায় সে দিনের ঘটনা মনে হয় তুচ্ছ।
বিস্ফারিত চোখে টেলিভিশনের পরদায় চেয়ে দেখলাম, মাননীয় সদস্যদের মধ্যে প্রবল হাতাহাতি চলছে। কেউ বা চোখে রুমাল চাপা দিয়ে দৌড়ে বার হচ্ছেন। টেলিভিশনের স্ক্রিন থেকে ‘মরিচ’ গুঁড়ো কি ছিটকে আমার চোখেও পড়ল! চোখটা কড়কড় করছে কেন? আমার দেশের গণতন্ত্র নিয়ে বেশ একটা গর্ব ছিল মনের মধ্যে। প্রচণ্ড আঘাত পড়ল সেখানে। ঘটনাচক্রে সাংসদ জীবনে অনেক বিদেশি অতিথিকে স্বাগত জানাতে হয়েছে, আলাপচারিতা হয়েছে ইউরোপ, আমেরিকা থেকে আসা ডেলিগেশনের সঙ্গে। আমাদের বিদেশ মন্ত্রক কমিটির মুখোমুখি হলে প্রথমেই তাঁরা জিজ্ঞাসা করতেন, ‘আচ্ছা, তোমরা কী ভাবে তোমাদের গণতন্ত্র ধরে রেখেছ বলো তো?
তোমাদের নিকট-প্রতিবেশী রাষ্ট্র অনেকেই পারেনি, গণতন্ত্র থেকে পদস্খলন হয়েছে তাদের!’ আমাদের সকলের মুখে তখন এক চিলতে অহংকারের হাসি ফুটে উঠত। কম কথা নয়, বহুবর্ণময় বিরাট দেশ। ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের বিরাট সমাবেশ। হতে পারে আমাদের গণতন্ত্র একেবারে দোষত্রুটিহীন নয়। তবু নির্বাচন হয়, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে থাকে দেশ চালানোর ক্ষমতা। মনে রাখবেন, পার্লামেন্টারি কমিটিগুলি হয় সর্বদলীয়। নানা বিষয়ে মতভেদ থাকা বিচিত্র নয়। কিন্তু গণতন্ত্রের এই বাহবা, এর কৃতিত্ব আমরা সকলেই ভাগ করে নিতাম। আজ তাই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আচরণে লজ্জায় অধোবদন। |
সকালের দিকে খবর পেয়েছিলাম, পার্লামেন্টের সিকিয়োরিটির লোকজন কম্বল আর অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হয়েছে। কারণ কোনও কোনও সদস্য আত্মাহুতি দিতে পারেন বলে হুমকি দিয়েছেন। বোঝা গেল নিরাপত্তা রক্ষীরা মরিচ স্প্রে-র জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তবে যা শুনছি, নিরাপত্তা রক্ষীদের চাইতে বেশি ভরসা নাকি ছিল দলীয় বলবান সাংসদদের ওপর। কে স্পিকারের কাছে থাকবেন, কারাই বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে রক্ষণাত্মক ভূমিকায়, এমন কয়েকটি নামও শোনা যাচ্ছে। আশা করব এ কথা সত্য নয়। এ ধরনের ঘটনার বিবরণে এক-আধটু রং চড়ে যাওয়া বিচিত্র নয়। কারণ সত্য হলে গণতন্ত্রের বিপদ আরও বেশি।
একটা কথা ভেবে কি আমরা একটু সান্ত্বনা পেতে পারি? আত্মাহুতি দেওয়া, রক্তারক্তি হওয়া, মাথা ফেটে যাওয়ার চাইতে চোখ জ্বালা করা, দমবন্ধ ভাব হওয়া তুলনায় নিরীহ নয় কি? কে যেন ছুরি বার করেছিলেন অথবা মাইক্রোফোনের ভাঙা টুকরো! রক্তপাত ঘটেনি, শুধু টেবিলের কাচ আর ল্যাপটপ ভেঙেছে! কিন্তু সান্ত্বনার বদলে লজ্জাবোধই হচ্ছে। কিছু দিন ধরেই খবরে পড়ছিলাম, ভারতীয় মেয়েরা কর্মস্থলে যাচ্ছেন সঙ্গে আত্মরক্ষার জন্য মরিচ স্প্রে জাতীয় কিছু নিয়ে। হঠাৎ করেই বিক্রি বেড়ে গিয়েছে এই সব ঝাঁঝালো স্প্রে-র। ধন্যবাদ দেওয়া যেতে পারত এই স্প্রে-র আবিষ্কারক, কী যেন নাম, মিস্টার লগমানকে। আমাদের দেশেও মির্চ মশালা ব্যবহার হয় না, এমন নয়। কিন্তু যদি দেশের মেয়েদের ভ্যানিটি ব্যাগে মরিচ স্প্রে নিয়ে ঘুরতে হয়, তবে বুঝতে হবে কোথাও গলদ আছে। সুস্থ, স্বাভাবিক গণতন্ত্রে সকলের স্বচ্ছন্দ বিচরণের সমান অধিকার থাকার কথা। এখন এই মরিচ গুঁড়ো ঢুকে পড়েছে যেখানে আলাপ-আলোচনা-বিতর্কের মধ্য দিয়ে ভারতের ভাগ্য নির্ধারিত হওয়ার কথা, সেই উচ্চতম সংসদ কক্ষে।
যে সব সাংসদ এই অসংসদীয় এবং অসভ্যোচিত আচরণ করেছেন, তাঁদের দল-মত-নির্বিশেষে আমরা ধিক্কার জানিয়েছি। প্রাথমিক ভাবে স্পিকার সাসপেন্ড করেছেন। কঠিনতম শাস্তি এঁদের পাওয়া উচিত, এ বিষয় কোনও দ্বিমত নেই। একটা জিজ্ঞাসা কিন্তু সকলের মনে উঠে আসছে। এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে দেওয়া হল কী ভাবে! এমন তো নয় যে, রাজ্যভাগ আগে হয়নি। আমার সাংসদ থাকাকালীন তিনটি ছোট রাজ্য সৃষ্টি হয়েছিল। এমন নীরবে হল যে, ভাল করে মনেই পড়ছে না কী ভাবে হল। হ্যাঁ, লালুজি প্রথম দিকে ঝাড়খণ্ড নিয়ে কিঞ্চিৎ চেঁচামেচি করেছিলেন। তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ীজি তাঁকে বুঝিয়েসুজিয়ে শান্ত করেছিলেন।
তেলঙ্গানার সমস্যাটি যে অত্যন্ত স্পর্শকাতর, এ কথা সকলের জানা। দু’পক্ষেরই বক্তব্য আছে। যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে শোনা হয়েছিল? গণতন্ত্র দেশের যে নেতৃত্বের কাছে রাজনৈতিক বিচক্ষণতা আশা করে, তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। ক’দিন পরেই আমরা মরিচগুঁড়ো কাহিনি ভুলে যাব। গণতন্ত্রের অসুখ কিন্তু গভীরে প্রবেশ করেছে। সব দল, সব রকমের দল— সকলে যদি তাদের জনপ্রতিনিধিদের সম্পর্কে সাবধান না হন, যাঁদের মধ্যে থেকেই ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব উঠে আসবে, তবে গণতন্ত্রের সমূহ বিপদ। এ কথা অস্বীকার করে লাভ নেই যে আজকের রাজনীতিতে বলবান মানুষের ভূমিকা আছে, ধনবানের প্রয়োজন আরও বেশি। কিন্তু দেশ পরিচালনা করতে লাগে বিবেকবান মানুষ।
|