বারাক ও মিশেল ওবামার শিরঃপীড়ার অবসান হইয়াছে। ইরানের পরমাণু-অস্ত্র বা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ নহে, আমেরিকার প্রথম দম্পতির সংকট ছিল অন্যত্র। হোয়াইট হাউসে নৈশভোজে প্রোটোকল মানিয়া কী ভাবে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া অলাঁদকে আপ্যায়ন করা হইবে। অলাঁদ ও তাঁহার সঙ্গিনী ভ্যালেরিকে আমন্ত্রণ জানাইয়াছিল আমেরিকা। কিন্তু জুলি গ্যয়েত নামে এক অভিনেত্রীর সহিত প্রেমের কারণে অলাঁদ-ভ্যালেরি ছাড়াছাড়ি হইয়া যায়। ফলে হোয়াইট হাউসকে তড়িঘড়ি ভ্যালেরির নাম সমন্বিত নৈশভোজের তিনশত আমন্ত্রণপত্র বাতিল করিয়া দিতে হয়। অতঃপর ফরাসি প্রেসিডেন্ট কাহার পাশে বসিবেন, ভোজের শেষে কাহার সঙ্গে নাচিবেন, তাহা লইয়া জল্পনার ঝড় বহিয়া যায়। সভ্যতার সংকট নহে, মার্কিন কূটনীতি তখন ভব্যতার প্রোটোকল লইয়া ব্যতিব্যস্ত ছিল। প্রোটোকল অতি বিষম বস্তু। তবে অভিজ্ঞরা জানেন, ইংরাজি প্রোটোকল শব্দ গ্রিক প্রোতোকোলান হইতে উদ্ভূত। আথেনীয় সভ্যতায় কোনও জরুরি নথি রচনার পর আঠা লাগাইয়া একটি অতিরিক্ত পৃষ্ঠা সাঁটিয়া দেওয়া হইত। উহাই প্রোতোকোলান। আঠা-লাগানো অতিরিক্ত পৃষ্ঠা অনায়াসে ফেলিয়া দেওয়া যায়। বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট এভো মোরালেস তাহা করিয়াছিলেন। বছর কয়েক আগে তিনি সোয়েটার পরিয়া স্পেনের রাজার নিকট গিয়াছিলেন। হইচই বাধিলে সাফ জানাইয়াছিলেন, প্রোটোকল মানিয়া চলিতে তিনি অভ্যস্ত নহেন। গ্রিক সভ্যতা কিংবা লাতিন আমেরিকান স্পষ্টবাদিতা হইতে ওয়াশিংটন দূর অস্ত্। কিন্তু ঠেকায় পড়িলে অতি বড় বিষম বস্তুকেও বিসর্জন দিতে হয়। সুতরাং শেষ অবধি সংকট কাটিয়াছে। নৈশভোজের শেষে নাচের আসর ছিল না। পরিকল্পনা মাফিক একাকী অলাঁদের আসন নির্দিষ্ট হইয়াছিল বারাক ও মিশেল ওবামার মাঝে। দুই রাষ্ট্রপ্রধান অতঃপর আমেরিকা-ফ্রান্স মিত্রতা লইয়া বাগ্মিতা বিস্তার করিয়াছেন। অলাঁদ বলিয়াছেন, ফরাসি ও মার্কিনরা পরস্পরকে ভালবাসে, কিন্তু মার্কিনরা সে কথা স্বীকার করিতে লজ্জা পায়। ফরাসি রসবোধ মারাত্মক বটে! |
সমস্যাজনকও বটে। অন্তত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে। অলাঁদ দুই বান্ধবীর কাহাকেও বিবাহ করেন নাই, তাঁহার পূর্বসূরি নিকোলাস সারকোজি প্রেসিডেন্ট পদে বসিয়া স্ত্রী সিসিলিয়াকে বিসর্জন দিয়া কার্লা ব্রুনিকে বিবাহ করিয়াছিলেন। অথচ অমিতশক্তিধর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ এবং রাজনীতির মেজাজমর্জি অন্যরূপ। ফরাসি কেতায় ভালবাসার সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করিতে সে লজ্জা পায়। লজ্জা পায় বলিয়াই ফরাসি অতিথি কাহার পাশে বসিবেন তাহা লইয়া ব্যতিব্যস্ত হয়। মার্কিন রাজনীতি গণতন্ত্র, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য লইয়া মুখর হইলেও রাজনীতিকদের পারিবারিকতার প্রশ্নে প্রবল রক্ষণশীল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধখ্যাত প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট একদা তাঁহার সচিবের প্রেমে পড়িয়া স্ত্রীকে বিদায় দিয়া সচিবের সহিত জীবন কাটাইবার কথা ভাবিয়াছিলেন। তাঁহার মা পরিষ্কার জানাইয়া দেন, বিবাহবিচ্ছেদ করিলে রুজভেল্ট পারিবারিক সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত হইবেন। মার্কিন চিন্তায়, রাষ্ট্রনেতার জীবন হইবে ‘নিষ্কলুষ’। বিবাহবহির্ভূত প্রেম বা যৌনতার কলঙ্করেখা পড়িবে না। সেই কারণে রাষ্ট্রপ্রধানদের ব্যক্তিজীবনে কোথায় কেনেডি-মেরিলিন, ক্লিন্টন-মনিকা অবৈধ চুনকালি পড়িয়াছে, সেই কেচ্ছায় দেশটি আকুল থাকে, শিহরিত হয়। ফ্রান্স এই দমিত যৌনতায় নাই। রাষ্ট্রনেতার শরীরী দাবি সে স্বীকার করে বলিয়া নেপোলিয়নের মতো মহাবীরও রণাঙ্গন হইতে স্ত্রী জোসেফাইনকে চিঠিতে জানান: তিন দিনের মধ্যে বাড়ি, স্নান করিয়ো না। এমন দেশের অতিথি লইয়া আমেরিকার বিড়ম্বনা হইবে না তো কাহাকে লইয়া হইবে? বস্তুত, হোয়াইট হাউসের অলাঁদ-সমস্যা বুঝাইয়া দিল, প্রয়াত মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটন বুঝিতে পারেন নাই, প্রকৃত ‘সভ্যতার সংঘর্ষ’ ইসলাম বনাম খ্রিস্টধর্মের নহে। |