প্রবন্ধ ২...
ভ্যালেন্টাইনে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন ভ্রম হয়
নিউমার্কেটগামী অটো রিকশা। গাড়ির জোরালো আওয়াজ ছাপিয়ে পাশে-বসা মা ও মেয়ের সংলাপ, টুংটাং কানে এসে বাজছে। মা: ‘এখনই এত-এত জিনিস কিনতে হবে?’ মেয়ে: ‘প্লিজ, প্লিজ মা, শুধু তো জাম্পস্যুট কিনব আর ছোট্ট একটা ব্যাগ। কেমন জানো তো, হালকা লেদারটাচ দেওয়া ফ্যাব, না?’ মা: ‘দরকার কী, এখন তো কোনও পিকনিক-টিকনিক নেই আর!’ মেয়ে: ‘ওয়ে মা! ভ্যালেন্টাইনস ডে আসছে যে!’ মা: ‘কোথায় ঘুরবি সে দিন?’ মেয়ে: ‘ওই তো, মুকেশ থাকবেই, আর যেন কারা সব— রিয়াজ, সোহম, বুদ্ধদেব...।’ ‘মুকেশকে তো জানি, কিন্তু ওরা, চিনিস ওদের?’ মা-র গলার উদ্বেগ আমাকে ছোঁয়। মেয়ের গলায় লঘু সুর, ‘কুল মা! ফ্রেন্ডস অব হিম। ঘুরব, ফিরব, চলে আসব।’ ওরা নেমে গেল। মা কতখানি ঠান্ডা হলেন জানি না, কিন্তু আমার হাত-পা হিম হয়ে এল কেবলই, অচেনা মেয়েটির জন্য চেনা আশঙ্কায়।
সদ্য চাকরিতে ঢুকেছে আমার বোনঝি। ফোন করেছিল সে দিন। বলল, ‘দেখ না মাসু, ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তেও অফিস। কী আর করব, সারা দিন বোর হয়ে সন্ধেবেলাতেই হ্যাং-আউট!’ ‘কাদের সঙ্গে?’ ‘আরে! আছে, আছে। আমি-ই ভাল করে চিনি না সকলকে তো তোমাকে কী বলব! এনিওয়ে, ভাবো তো, ওই যে তোমাদের বাংলায় বলে না, রাতপাখি! আমিও না-হয় রাতপাখি হয়েই উড়ে আসব।’ ওর ডানার হাওয়া-কাটা উল্লাস ফোনের মধ্যেই টের পেলাম বেশ। কিন্তু আমার সতর্ক গলা বলল, ‘সাবধানে ঘুরিস, দিনকাল ভাল নয়।’ ও দিক থেকে ঝাঁঝালো উত্তর: ‘তুমি এমন হাইপার হয়ে যাচ্ছ কেন গো দিন-দিন? আমার বয়ফ্রেন্ড তো থাকবে সঙ্গে।’
দু’টি আলোকোজ্জ্বল ছবি। ইউ এস পি, অনাবিল প্রেমের আনন্দ। পাখির মতন, নির্ভার। কিন্তু ওই নিষ্পাপ ছবি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে, আমার সামাজিক চোখ আমাকে দেখতে শেখায়, বয়ফ্রেন্ড কী ভাবে বর্বরতায় শামিল হয়েছে বার বার।
আজকের কথা নয়। আলাদা করে ভ্যালেন্টাইনস ডে ছিল না তখন। কিন্তু প্রেমিকের হাতছানিতে উড়ে আসার মতো সকাল-দুপুর তো ছিলই! ঘর থেকে এক কাপড়ে বেরিয়ে-পড়া ছিল। নবীনচাঁদ বড়াল লেনের শিউলি নার্গিসরা তাদের নিজ মুখে আমাকে শুনিয়েছে কী ভাবে শুধু ভালবাসা-সম্বল জীবন তাদের এক এক জনকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে সারি-সারি মাংসের দোকানের ঝাঁপ-তোলা অন্ধকারে। তারা বলেছে, ‘লাভারের সঙ্গেই তো ঘর ছেড়েছিলাম দিদি, তখন কি জানতাম নরকে এনে তুলবে!’
রজ্জুতে সর্পভ্রম হয় আজকাল। ভ্যালেন্টাইনস ডে-র মধুরতা ভাবতে গিয়ে চাক্ষুষ করি ফ্র্যাঙ্কেস্টাইন-এর বীভৎসতা। ভ্যালেন্টাইন সন্তদের কাছে মার্জনা চেয়ে নিয়ে ভাবতে বাধ্য হই— রূপকথা নয়, মৃত্যুফাঁদ পাতা ভুবনে, মেয়েরা ঝাঁকে ঝাঁকে সেখানে এসে ধরা পড়ছে।
এই ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন গড়ে তুলেছি তো আমরাই। আমাদের সমাজ প্রবচনও বেঁধে দিয়েছে: সোনার আংটিসম পুরুষ, বাঁকা হোক, কলঙ্ক ধরে না। দিনের পর দিন তার জন্য, একসঙ্গে বেড়ে-ওঠা একটি মেয়ে তুলনায় ভাল লেখাপড়া, ভাল খাবারদাবার, ভাল আদরযত্ন জুগিয়ে তাকে মাথায় তুলেছি আমরাই তো! সে বুঝতে শিখেছে, ‘মেয়ে মানে আত্মত্যাগ, মেয়ে মানে আমাতে সমর্পিত প্রাণ, আর সর্বোপরি মেয়ে মানে শারীরিক আরাম!’ এই চিন্তনে আরও মদত দেয় সিনেমা, বিজ্ঞাপন, টিভি সিরিয়াল ও পরিবারের গুরুজনবর্গ। এমনকী একটি মেয়ে নিজেও ‘বয়ফ্রেন্ড’কে বাড়ির শাসন-খাঁচা থেকে পরিত্রাতা ভেবে বসে! ভাবে, ঘোড়ায় চড়ে আসা রাজপুত্র! তাকে সমান-সমান ভাবার স্পর্ধা সমাজ আর দিল কোথায়! আজও শিক্ষিত মেয়েরা তার ভালবাসার জনের উচ্চতায় নিজেকেও বসাতে গিয়ে, তার ভুলত্রুটি শুধরে দিতে চেয়ে কঠোর হতে গিয়ে, মনের আদিম থেকে উঠে-আসা স্বর শুনতে পায়, ‘ছিঃ, তুমি না মায়ের জাত! সর্বংসহা!’
মেয়ে আজ শুধুই কামনার, লালসার সামগ্রী। বসিরহাটে, বারাসতে, বাবুঘাটে লরির উপর তার ছিন্নবিচ্ছিন্ন মন ও শরীর পড়ে থাকে। হ্যাঁ, সে-ও তো নিবিড় বিশ্বাসে, আনন্দে বয়ফ্রেন্ড কিংবা প্রেমিকের সঙ্গে মিলতে গিয়েছিল। যে ভাবে ভ্যালেন্টাইনস ডে উদযাপন করতে চেয়ে এ লেখার শুরুর দুই তরুণী। আমি নারী। আমার জীবনমুখী চিন্তা আমাকে এই অতল অসুস্থতার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, নিরুপায়! ভাবাচ্ছে, ভ্যালেন্টাইন ও ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন কি তবে সমার্থক?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.