অসুস্থ শিশুর ছবি নিয়ে ‘বাবা-মা’র ভিক্ষাবৃত্তি
লিউকোমিয়ার জন্য ১৫ শতাংশ, হৃদযন্ত্রে বড় মাপের কোনও অসুখ বাধালে ২০ শতাংশ।
মাঝবয়সী লোকটি গলা নামিয়ে জানিয়েছিল, “তবে কী জানেন, ক্যানসারের ক্ষেত্রে আমরা একটু ‘রিবেট’ দিই। ভিক্ষা করে যা কামাই হবে পেশেন্ট পার্টি তার ১০ ‘পারসেন্ট’ দিতে রাজি হলেই আমরা কাজ হাতে নিই।”
দুঃস্থ চেহারা। কপালে বিনবিনে ঘাম। গলায় ঝুলছে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অসুস্থ শিশুর সচিত্র পরিচয়পত্র। ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া পাঁচ-দশ টাকার লালচে কুপন নিয়ে বাসে-ট্রেনে সেই মৃত্যুমুখী বাচ্চাটির চিকিৎসার জন্য অর্থ সংগ্রহে নেমেছেন ‘পিতা-মাতা’।
তবে আদপেই ওরা অসুস্থ শিশুটির বাবা-মা নন, কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন শাখা) পল্লবকান্তি ঘোষ বলছেন, “হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কোনও শিশুর পরিচয়পত্র জোগাড় করে তার মা-বাবা সেজে এ ভাবেই টাকা তুলছে একটি চক্র। শনিবার এমনই এক জন পুলিশের ফাঁদে পা দিয়েছে। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে জেরা করে ওই চক্রের বিস্তার কতটা তার খোঁজ চলেছে।”
কলকাতা ও লাগোয়া শহরতলি জুড়ে বাসে-ট্রাম-ট্রেনে নিত্য যাতায়াত করেন অথচ এমন ‘বাবা-মা’র দেখা পাননি, এমন নজির কম। কখনও ক্যানসারে আক্রান্ত শিশু কখনও বা ‘হার্টের ভালভ্’-এ ফুটো নিয়ে হাসপাতালে নিশ্চুপে পাঞ্জা লড়া কিশোরীর ছবি গলায় ঝুলিয়ে করুণ কণ্ঠে ভিক্ষা চেয়ে বেড়াচ্ছে তারাএ ছবি আকছার দেখা গিয়েছে। তাদের আর্তির কাছে আত্মসমর্পণ করেননি এমন মানুষও কম। পাঁচ কিংবা দশ টাকার কুপন বিকিয়ে ভিড় বাস বা ট্রেন থেকে তাদের আয়ও নেহাত কম নয়। পুলিশের হিসেব বলছে দিনান্তে তা প্রায় বিশ থেকে পঁচিশ হাজার টাকা। শহর উজিয়ে কুপন হাতে সেই সব ‘মা-বাবা’র দেখা মিলেছে শহরতলির ট্রেনেও। রমরমিয়ে চলা সেই ব্যবসা হঠাৎই হোঁচট খেয়েছে। কী করে?
অভিযোগটা করেছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার রামনগর এলাকার চাঁদা গ্রামের এক দম্পতি, রঞ্জিত ও পুষ্প প্রতিহার (নাম পরিবর্তিত)। পুলিশের কাছে তাঁরা জানান, ছেলে অসুস্থ ঠিকই কিন্তু তার চিকিৎসার জন্য ‘ভিক্ষাবৃত্তি’ করতে পথে নামেননি তাঁরা। অথচ তাঁদের পাঁচ বছরের ছেলে সুপ্রতীমের ছবিই কিনা গলায় ঝুলিয়ে টাকা তুলছে এক দম্পতি। বিষয়টি তাঁরা নজরে এনেছিলেন কলকাতার এক পরিচিত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থারও। ওই সংস্থার উদ্যোগেই এরপর তৎপর হয়েছিলেন কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দারা।
রঞ্জিতবাবু বলেন, “আমাদের পাঁচ বছরের ছটফটে ছেলেটার বছর দুই আগে ‘লিমফ্যাটিক লিউকোমিয়া’ ধরা পড়েছিল। চিকিৎসা শুরু হয়েছিল কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ক্যানসার রিসার্চ ইনস্টিটিউট হাসপাতালে। কোনওরকমে যখন চিকিৎসার খরচ জোগাচ্ছি তখন এক দিন দেবদূতের মতো সামনে এসেছিলেন দুই মাঝবয়সী ব্যক্তি। নিজেদের একটি বেসরকারি সংগঠনের কর্মী হিসেবে পরিচয় দিয়ে জানিয়েছিলেন, ছেলের চিকিৎসার জন্য তারা কিছু আর্থিক সাহায্য করতে চায়। তবে শর্ত ছিল, চিকিৎসার জন্য কত খরচ পড়তে পারে তার একটা সম্ভাব্য খরচ যেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিয়ে নিই।
আর চেয়ে নিয়েছিল আমার ছেলের দু-কপি ছবি।”
বেহালার এক ছোট্ট কারখানার কর্মী রঞ্জিতবাবুর সে সময়ে এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনও কারণ দেখেননি। নথিপত্র তুলে দিয়েছিলেন ওই দু’জনের হাতে। দিন কয়েক পরেই অবশ্য তারা জানিয়েছিল তাদের টাকা তোলার পদ্ধতি। দেখিয়েছিল সেই কুপন। রঞ্জিতবাবু বলেন, “ওই দু’জন আমাকে জানায়, বাবা-মা সাজিয়ে এক দম্পতিকে বাসে-ট্রেনে তুলে দেওয়া হবে। যাদের গলায় ঝুলবে আমার ছেলের ছবি। ভিক্ষা করে যা আয় হবে তার ১০ শতাংশ টাকা কেটে বাকিটা আমার হাতে তুলে দেওয়া হবে।” শুনেই চমকে উঠেছিলেন রঞ্জিতবাবু। জানিয়ে ছিলেন কোনও আর্থিক সাহায্যের দরকার নেই। তাঁর কথায়, “আমার অসুস্থ ছেলেকে
নিয়ে ব্যবসা করবে, আর আমি সেই টাকায় সুপ্রতীমের চিকিৎসা করাব, তা হয় নাকি!”
তিনি রাজি না হলেও ‘ব্যবসা’ কিন্তু থেমে থাকেনি। কিছু দিন পরেই রঞ্জিতবাবু খোঁজ পেয়েছিলেন একই সঙ্গে, কলকাতার দক্ষিণ শহরতলি গড়িয়া এবং ই এম বাইপাসের উপরে চলন্ত বাসে ও ট্রেনে তাঁর ছেলের ছবি ঝুলিয়েই ঘুরতে দেখা গিয়েছে এক দম্পতিকে। ওই হাসপাতাল থেকেও রঞ্জিতবাবুকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল, ছেলের চিকিৎসার নামে এ ভাবে ‘ব্যবসা’ করলে ওই হাসপাতালে আর চিকিৎসা করানো যাবে না।
কিন্তু কী করে বন্ধ করবেন ওই ‘ব্যবসা’? পুষ্পদেবী বলেন, “আমাদের তখন দিশেহারা অবস্থা। সারা দিন মাথায় ঘুরছে, যদি আমার ছেলের চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যায়!” এই সময়ে কলকাতার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ হয় রঞ্জিতবাবুর।
ওই সংগঠনের পক্ষে সুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “রঞ্জিতবাবুর কথা শুনেই বুঝেছিলাম এই ভিক্ষাবৃত্তির পিছনে বিরাট এক চক্র জড়িয়ে।
আমরা ঘটনাটি মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ে এবং কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগকে জানাই।”
তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, ওই চক্রের মূল ঘাঁটি চুঁচুড়া। সেখানে গোপনে হানা দিয়েও অবশ্য খোঁজ মেলেনি অভিযুক্তদের। গোয়েন্দা বিভাগ সূত্রে জানা গিয়েছে, এর পরেই শুরু হয় অভিযুক্তদের ‘মোবাইল ট্র্যাক’ করা। দেখা যায় কখনও ব্যান্ডেল-বর্ধমান কখনও বা কলকাতার বুকে একই ভাবে ‘ব্যবসা’ চালাচ্ছে তারা। সম্প্রতি বইমেলাতেও তাদের দেখা গিয়েছিল বলে জানা গিয়েছে। শনিবার সন্ধেয় টোপ ফেলে পুলিশ। আর সেই ফাঁদেই পা দেয় ওই চক্রের এক পান্ডা। তাকে জেরা করেই আপাতত খোঁজ চলেছে ওই ব্যবসায় জড়িত অন্যদের।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.