শিবঠাকুর বা তাঁর পুত্র গণেশ কৈলাস থেকে চিন পাড়ি দিয়েছেন কবেই। এ বার প্রজাপতি ব্রহ্মার পালা।
চিনে তৈরি বেনারসি শাড়ির কথা আগেই জানা গিয়েছে। বাঙালির বিয়ের বাজারে চৈনিক আগ্রাসন এখন আর শুধু শাড়ির আঁচলে বাঁধা নেই। বস্তুত এ মরসুমে বাঙালির শুভ পরিণয়ের পরতে-পরতে চিনা গন্ধ! নেমন্তন্নের কার্ড দিয়ে থেকে শুরু। প্রীতিভোজের আইসক্রিমের চামচেয় শেষ। মাঝে তত্ত্বের ডালি কিংবা উপহার সামগ্রীর বাহারি সাজসজ্জাতেও চিনা-কানেকশন!
খটকা লাগছে? বাস্তব কিন্তু এমনটাই।
সদ্য পাওয়া বিয়ের নেমন্তন্ন কার্ডটাই ধরুন না! মলাটে রাধা-কৃষ্ণ বা সিদ্ধিদাতার যে থ্রি-ডি অবতারকে দেখে চোখ টেরিয়ে গেল, তাঁরা আদতে বিশুদ্ধ চাইনিজ। আবার বেতের ডালিতে রেশমি রুমাল-টানা তত্ত্বের ট্রে-র মধ্যে কেউ রাবীন্দ্রিকতা খুঁজে পেতেই পারেন। যদিও এমন ট্রে’র চোদ্দো আনা এখন ‘মেড ইন চায়না!’
অনেকেই জানেন না, কলকাতার চিনে রেস্তোরাঁয় ধনেপাতার কাইমাখা চিকেন মাঞ্চুরিয়ান পদটির সঙ্গে আসলি চিনের দূরতম সম্পর্ক নেই। তথাকথিত ‘চাইনিজ’ রান্নাটির জন্ম এ দেশে। আবার ভারতীয় কচি-কাঁচার হাতের খেলনা-পুতুল, বেলুন-বাঁশি থেকে শুরু করে বাড়িতে সাজানো ঝকঝকে চেহারার ঠাকুর-দেবতারা অনেকেই জন্মসূত্রে চৈনিক। খাস মেনল্যান্ড চায়নার কারিগরের হাতে তৈরি। এখন দেখা যাচ্ছে, বাঙালির বিয়ের আয়োজনের খুঁটিনাটিতেও নাক গলাতে শুরু করেছে সেই চিন!
এবং বাঙালি ক্রমেই মজছে চিনে-ম্যাজিকে। বিয়ের কার্ডে একটু স্বতন্ত্রতা খুঁজতে গিয়ে যেমন মজেছেন কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষ। বলছেন, “কার্ডটা অভিনব। বাজেটেও পুষিয়ে গেল। পরে জানলাম, চিনে সরঞ্জামে বানানো!”
দাম চল্লিশ থেকে একশো টাকা। চৈনিক হাতযশের স্বাক্ষর বয়ে হিন্দু দেবদেবী খচিত এমন আমন্ত্রণপত্র ছেয়ে ফেলেছে কলকাতার বাজার। কলেজ স্ট্রিট-ক্যানিং স্ট্রিটে বিয়ের কার্ডের সাবেক মহল্লার আনাচে-কানাচেও ত্রিমাত্রিক অবয়বধারী ‘মেড ইন চায়না’ দেবদেবী দৃশ্যমান। কোনওটার কভারে গণেশ, কোথাও শিব, কোথাও গোপিনী পরিবৃত রাধা-কৃষ্ণ। “বিয়ের কার্ডে গণেশ বা কৃষ্ণকে দেখলে আজকের বাঙালি খুশি হচ্ছে। তাই কাটতি ভালই।” জানালেন মহাত্মা গাঁধী রোডের ব্যবসায়ী গোপাল সাহা।
থ্রি-ডি কার্ডে চিনা-সূত্রের বৃত্তান্ত সর্বত্র খদ্দেরদের কাছে চাউর না-হলেও বিক্রেতারা বিলক্ষণ জানেন। এমনকী, ঝকঝকে বিপণি খুলে বসা একটু বড়-সড় ব্যবসায়ীরা সটান চিনে পাড়ি মাল কিনে আনছেন। ওঁদের অভিজ্ঞতা, চিনের ইয়ু শহরের প্রকাণ্ড ফুতিয়ান মার্কেটে এ দেশের গেরস্ত মধ্যবিত্তের জীবনে জরুরি সব কিছু মজুত। ঠিকঠাক বুঝিয়ে দিলে বিয়ের কার্ডে সংস্কৃত মন্ত্রটাও দেবনগরী লিপিতে নিখুঁত ভাবে লিখে দেবেন চিনা কারিগর, তা-ও আবার চোখ জুড়োনো মেটালপ্রিন্টের ছাপে! বিয়ের তত্ত্ব হোক বা পুজো-পার্বণ-বচ্ছরকার দিনে কর্পোরেট সৌজন্যের আধার সুদর্শন বাস্কেট সব কিছুর অঢেল পসরা সাজানো। এক লপ্তে বেশি মাল নিলে বেজায় সস্তাও। ফলে লাভের পোয়াবারো। পার্ক স্ট্রিটের একটি বিপণির কর্ণধার মনীশ ঝাঝারিয়া পরিষ্কার বললেন, “সৃষ্টিশীলতা, বৈচিত্র্য বা পেশাদারিত্ব— দেশি মাল কিছুতেই চিনের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছে না। ওদের ফিনিশিং অনেক ভাল।” হরিশ মুখার্জি রোডের বিপণি-কর্ত্রী বন্দনা শরাফ ফারাকটা ‘হাতে-কলমে’ বোঝালেন। বাহারি নক্শাধারী মোরাদাবাদি ধাতব বাক্সের পাশে তিনি রাখলেন তারই এক চিনা-সংস্করণ। ওঁর দাবি, আসল মোরাদাবাদির গায়ে মাস দুয়েকেই কালচে ছোপ, অথচ ‘চায়না মেড’ মোরাবাদাবাদি আগাগোড়া ঝকমকে। “নকলনবিশির গুরুমারা বিদ্যেয় ওরা কামাল করছে!” মন্তব্য বন্দনার।
পরিণামে মার খাচ্ছেন মেরঠ-মোরাদাবাদ-জয়পুর-আমদাবাদের হস্তশিল্পীরা, বংশ পরম্পরায় যাঁরা বিবিধ কারুশিল্পের ঐতিহ্য বহন করে আসছেন। ঠিক যেমন চিনাদের নকল-নৈপুণ্যের জেরে অশনি সঙ্কেত দেখছেন বেনারসের আসল বেনারসি শাড়ির স্রষ্টারা।
কিন্তু ঘটনা হল, আম খদ্দেরের সিংহভাগই শিল্পের এতিহ্য বা গভীর খুঁটিনাটি নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামান না! তাঁদের মবল বিবেচ্য, জিনিসটা দেখতে কত আকর্ষণীয়। “ওই দেখনদারিতেই দেশি মালকে দশ গোল দিচ্ছে চিনারা।” প্রতিক্রিয়া এক বিপণি-কর্তা। ওঁরা দেখাচ্ছেন, চিনা ট্রে বা বাক্সের ডিজাইনে বৈচিত্র্য কত বেশি! বেতের সঙ্গে পাট বা ধাতব পাত্রের সঙ্গে নানা কিসিমের কাগজের মিশেলে তাক লাগাতেও চিনারা লা জবাব। ফাইবার, পলিরেজিন থেকে শুরু করে ভুট্টার খোসার মতো অকিঞ্চিৎকর উপকরণের ট্রে-বাস্কেটেও চমক! উপরন্তু উপহারসজ্জার রঙিন প্লাস্টিক-ফিতে বা নকল ফুল-টুলের পাইকারি দাম এখানে যা, চিনের বাজারে
তার অর্ধেক। অতএব, বাজারি নিয়মেই বাঙালির বিবাহ আয়োজনে চিনা পণ্যের চাহিদা-রেখা ঊর্ধ্বমুখী। উত্তর কলকাতার ক্যাটারিং-ব্যবসায়ী বুবাই পাল (প্রবীর) ও ভবানীপুরের সাবেক মিষ্টির দোকানের মালিক সুদীপ মল্লিক দু’জনের মুখেই শোনা গেল আইসক্রিমের ‘মেড ইন চায়না’ কাঠের চামচের মহিমা। দরে ফারাক নেই, তবু দেশি চামচ দৌড়ে পিছিয়ে। কারণ, তা কালিঝুলিমাখা, ছত্রাকপ্রবণ। প্রবীরবাবুর দাবি, “চিনে তৈরি নানা ধরনের কাগজের ন্যাপকিনও বিয়েবাড়িতে দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। সম্ভ্রান্ত অতিথিরা পছন্দ করছেন। চল বাড়লে দামও দ্রুত কমে আসবে।” সুদীপবাবু নিজেই চিনের গুয়াংঝাওয়ে গিয়ে বাজারে ঘুরে-ঘুরে তত্ত্বের মিষ্টি সাজানোর সুদৃশ্য বাক্স পছন্দ করেছেন। “ট্রে-বাক্স কিংবা নকল লিলি-গোলাপের কথা ছেড়ে দিন। লাড্ডু-সন্দেশের তলায় রাখার সামান্য কাগজটা পর্যন্ত অনেক উঁচু মানের। দামেও অর্ধেক।” জানাচ্ছেন তিনি। চাউমিন-চিলি চিকেনের বাইরের বঙ্গজীবনে চিনের সঙ্গে এ এক অন্যতর যোগ। প্রজাপতির নির্বন্ধেও শেষ কথা বলছে ‘মেড ইন চায়না!’ |