দাদাগিরির ছক্কায় বিতর্কের রং বদলে দিলেন মিঠুন
কেউ উদ্ধৃতি দিলেন ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের। কেউ টানলেন উইনস্টন চার্চিলের কথা। কেউ আবার বোঝানোর চেষ্টা করলেন চৌর্যতন্ত্রের কবলে পড়ে গণতন্ত্রের মহিমা হারানোর তত্ত্ব! আর এ সব কিছুর ধারেপাশে না-গিয়ে উত্তর কলকাতার এক প্রাক্তন বাসিন্দা সটান বলে দিলেন, “বেশি গণতন্ত্র থাকলে এখানে লাশ পড়ে থাকত!”
সোজা, অকপট এবং সপাট ওই ঝোড়ো ইনিংসেই শনিবার সন্ধ্যায় শহরের অভিজাত ক্লাবের লনে সহজ জয় হাসিল করে ফেললেন এক অভিনেতা। সদ্য যিনি সংসদীয় গণতন্ত্রের চৌকাঠ পেরিয়েছেন! তাঁর কাঁধে ভর করেই বিতর্ক-সভার চুলচেরা আলোচনার চেনা ছক ধরাশায়ী হয়ে পড়ল! শ্রোতাদের ভোটে পরাজিত হল ‘সাধারণ মানুষকেই সরাসরি সরকার চালাতে দেওয়া উচিত’ বিতর্ক-সভার এই প্রস্তাব। আরও স্পষ্ট করে বললে, জিতলেন মিঠুন চক্রবর্তী!
অথচ ‘দ্য টেলিগ্রাফ ন্যাশনাল ডিবেটে’র শুরুতে জনমত ‘টিম মিঠুনের’ দিকে ছিল না। বিতর্কের প্রতিপাদ্য, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র না সরাসরি জনতা-তন্ত্র কোনটায় মঙ্গল? প্রস্তাবের পক্ষে বলতে শুরু করে প্রাক্তন ব্যাঙ্ক-কর্ত্রী এবং অধুনা আম আদমি পার্টির নেত্রী মীরা সান্যাল যখন বর্তমান সংসদে কাজকর্মের করুণ হাল এবং সাংসদদের নিজেদের বেতন, ভাতা নিয়ে বেশি তৎপরতার তথ্য পেশ করছিলেন, সহমর্মিতা ছিল তাঁর দিকেই। বরং, তাঁর বিরোধিতা করতে গিয়ে উল্টো মতের বক্তাদের কটাক্ষও শুনতে হয়েছিল শ্রোতাদের কাছ থেকে! তবু বিতর্কের শেষে সেই মীরাকেই উঠে এসে মিঠুনকে নমস্কার করে বলতে হল, “অদ্ভুত বললেন আপনি!” ঠিক ২৪ ঘণ্টা আগের সন্ধ্যায় দিল্লিতে পতন ঘটেছে অরবিন্দ কেজরীবালের ৪৯ দিনের সরকারের। কলকাতায় তাঁর দলের সমর্থকদের যুক্তি-পুষ্ট প্রস্তাব পরাজিত হয়ে এ দিন বৃত্তই সম্পূর্ণ হল যেন!
‘দ্য টেলিগ্রাফ ন্যাশনাল ডিবেট ২০১৪’-এ অংশগ্রহণকারীরা। বাঁ দিক থেকে রুচির জোশী,
জেনারেল জে জে সিংহ, মীরা সান্যাল, সঞ্জয় ঝা, শাজিয়া ইলমি, ডেরেক ও’ব্রায়েন, স্মৃতি ইরানি,
মিঠুন চক্রবর্তী এবং সঞ্চালক নিধি রাজদান। রবিবার বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি।
এক দিকে মীরা, শাজিয়া ইলমি, সঞ্জয় ঝা ও রুচির জোশী। অন্য দিকে মিঠুন, ডেরেক ও’ব্রায়েন, স্মৃতি ইরানি এবং জে জে সিংহ। বিতর্কের শেষে অবশ্য মীরা ও শাজিয়াই শুধু বিশুদ্ধ ভাবে প্রস্তাবের পক্ষে থেকে গেলেন! তাঁদের প্যানেলের বাকি দু’জন কোনও দিকেই পুরোপুরি নন! আর বাকি তফাত গড়ে দিতে ছিলেন মিঠুন!
শুরুতে রয়্যাল ব্যাঙ্ক অফ স্কটলা্যান্ডের প্রাক্তন আধিকারিক মীরার পরিসংখ্যান বলছিল, সংসদে বিল পাশের বহর দিনে দিনে কমছে। অথচ সেই সংসদের দুই কক্ষই সাংসদদের বেতন ও নির্বাচনী কেন্দ্র ভাতা বাড়ানোর বিল মাত্র দু’দিনে পাশ করিয়ে নিয়েছে। মীরার কথায়, “তার মানে আমাদের সাংসদেরা চাইলে তৎপর হয়ে কাজ করতে পারেন! কিন্তু করেন না!” রাহুল গাঁধী না নরেন্দ্র মোদী এই বদ্ধ জলা থেকে বেরিয়ে ‘স্বরাজ্যে’র মহাসাগরে ডুব দেওয়ার আহ্বান ছিল মীরার।
প্রস্তাবের বিরোধিতা করে অন্য প্যানেলের গোড়ার বক্তা ডেরেক আবার শুরু করলেন রসিকতা দিয়ে। রাজ্যসভায় তৃণমূলের মুখ্য সচেতক কিঞ্চিৎ আত্মরক্ষার জন্যই পাল্টা আক্রমণের পথে গেলেন মীরাকে। বলছিলেন, সাংসদের বেতনের জন্য বছরে বড় জোর ২০-২২ লক্ষ খরচ হয়। কিন্তু ব্যাঙ্কিং সেক্টরে মাঝারি মাপের আধিকারিকও আছেন, যাঁর জন্য তাঁর কোম্পানির বছরে ৫০ লক্ষ খরচ হয়! সাংসদেরা কত টাকা বেতন পেলেন, সেটাই সব নয়! কিন্তু এটুকু বলা মাত্রই মীরার ঢাল হয়ে যেন এসে দাঁড়াল শ্রোতাদের একাংশ! “আমাকে শেষ করতে দিন”, বলে ডেরেক’কে আবেদন করতে হল। প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেও ডেরেক অবশ্য তাঁর দলনেত্রীর সিদ্ধান্তকেই নিজের মতের পক্ষে ব্যবহার করতে ছাড়েননি। তাঁর কথায়, “জঙ্গলমহল বা পাহাড়ে শান্তি এক জন তো এনেছেন! মহাকরণটা তুলে নবান্নে নিয়ে চলে গেলেন! এত বড় সিদ্ধান্তের জন্য জনে জনে আলোচনা করতে যাননি। কিন্তু কোথাও কোনও ইউনিয়ন বা অন্য কেউ বাধা দিতে পেরেছে?” তাঁর এই যুক্তির সঙ্গেও সরবে ভিন্ন মত ব্যক্ত করতে চাইছিলেন শ্রোতাদের কিয়দংশ। কিন্তু ডেরেকের সওয়াল তীক্ষ্ম “পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত করেছেন, কাজ করতে দিন। অসন্তুষ্ট হলে পরের ভোটে বদলে দেবেন!”
ডেরেকের যে মতকে পরে বিঁধেছেন লেখক রুচির। তৃণমূল সাংসদকে যাঁর পাল্টা কটাক্ষ, “নবান্নে মহাকরণ তুলে নিয়ে যাওয়া যদি বিরাট কৃতিত্ব হয়, পরের বার হয়তো শুনব কলকাতায় ট্রাফিক সিগন্যাল যে ঠিকমতো বদলাচ্ছে, সেটাও আপনাদের সরকারের কৃতিত্ব!” রুচির শেষ বিচারে অবশ্য জনতার হাতেই সব ক্ষমতা তুলে দেওয়ার পক্ষে নিঃশর্ত সমর্থন দেননি। রুচিরদের প্যানেলের আরও দুই বক্তা, আপ-এর মুখপাত্রী শাজিয়া এবং কংগ্রেসের মুখপত্র সঞ্জয় যা বোঝাতে চেয়েছেন, সেই সওয়ালকেই এক কথায় ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন সঞ্চালক-সাংবাদিক নিধি রাজদান। তাঁর কথায়, “সংখ্যাগরিষ্ঠের মত মানেই সেটা ঠিক কি না, ভেবে দেখতে হবে।” আবার উল্টো দিকে প্রাক্তন সেনাপ্রধান জে জে সিংহ সোজাসাপ্টা ভঙ্গিতে বলেছেন, “পানের দোকানে বা রাস্তার মোড়ে যে জনতা আলোচনা করে, তাদের মতের ভিত্তিতে সরকার চালাতে গেলে বিপদ হবে!”
জে জে-র যুক্তি, শিক্ষা ছাড়া গণতন্ত্রের মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। মানুষ যত শিক্ষিত হবেন, তাঁর পছন্দও তত উন্নত হবে। যে মতের পক্ষে দাঁড়িয়েই শেষ বক্তা, বিজেপি-র স্মৃতি ইরানি দৃপ্ত কণ্ঠে বলেছেন, “পূর্ণ স্বরাজ মানে পূর্ণ শিক্ষা।” সুইৎজারল্যান্ডে গণভোট নিয়ে আইন পাশ করার প্রথা এ দেশে কতটা অচল, ব্যাখ্যা দিয়েই স্মৃতির বক্তব্য, “উপযুক্ত নেতা তিনিই, যিনি মানুষকে ঠিক সেখানে নিয়ে যেতে পারেন, যেখানে তাঁর যাওয়া উচিত।”
কিন্তু তার আগে ছিলেন এক এবং অদ্বিতীয় মিঠুন! হিন্দি ও ইংরেজি মিশিয়ে যিনি বলেছেন, ছোট বেলায় চুটিয়ে পাড়াবাজি করেছেন। সবাই মিলে পুজোর চাঁদা তুলেছেন, জলসা করেছেন। পরে সেই পাড়ার সংস্কৃতি ভেঙেই যখন গোষ্ঠী তৈরি হল, পুরনো বন্ধুরা শত্রু হয়ে গেল। একটা পাড়া চালাতেই যেখানে এই অবস্থা, সরকার চালানো কি মুখের কথা! “সব কাজ সবাইকে দিয়ে হয় না!” নাগরিকের আচরণ যেমন হয়, সরকারের চরিত্রও তেমন ভাবে গড়ে ওঠে এই কথাও সহজ ভাবে বলেছেন মিঠুন। আর ব্রহ্মাস্ত্রটা প্রয়োগ করেছেন শেষে। “আমার এক সময় তিনটে বান্ধবী ছিল। এক বার হাতে-নাতে ধরা পড়ে বেদম মার খেলাম! গণতন্ত্রেও সব চাইলে হয় না। একটা বেছে নিতে হবে!” তৃণমূলের টিকিটে সদ্য রাজ্যসভায় যাওয়া সংসদ এটাও বলে রেখেছেন, “আমার এখনও শপথ নেওয়া হয়নি বলেই হয়তো আমাকে আপনারা ছাড় দিচ্ছেন!” সভায় তখন হাততালির ঝড়!
শেষ কালে ভোট নেওয়ার সময় বিতর্ক-প্রস্তাবের বিপক্ষে শ্রোতাদের হাত উঠবে এতে আর আশ্চর্য কী!
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.