স্কুল কলেজের পড়ুয়াদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়তে থাকায় দীর্ঘদিন ধরে উদ্বেগ ছিলই। শুক্রবার মালদহের এক অষ্টম শ্রেণির ছাত্রকে অপরহণের পর খুন করে টাকা আদায়ের চেষ্টার ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই অভিভাবক মহলে উদ্বেগ আরও বেড়েছে। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে নানা সময়ে যেভাবে অপরাধের সঙ্গে পড়ুয়ারা যেভাবে জড়িয়ে পড়েছে তাতে অভিভাবকদের পাশাপাশি চিন্তিত পুলিশ-প্রশাসনের কর্তারাও। তাঁদের অনেকেই জানিয়েছেন, তথ্য প্রযুক্তির বর্তমান যুগে টাকার মাধ্যমে সবই সহজলভ্য হয়ে পড়েছে। আর তার হাতছানিতেই ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে ‘জেনারেশন নেক্সট’।
তবে শুধুমাত্র মামলা, শাস্তি বা সাজার মাধ্যমে এই সমস্যা দূর করা সম্ভব নয় বলেই মনে করেন পুলিশের শীর্ষ কর্তারা। এর জন্য যেমন দরকার অভিযুক্তদের সমাজের মূলস্রোতে ফেরানো, তেমনিই দরকার ব্যাপক সচেতনতা অভিযান। এই প্রসঙ্গে কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন গোয়েন্দা কর্তা কথা উত্তরবঙ্গের আইজি জাভেদ শামিম বলেন, “পুলিশে চাকরির সুবাদে বহুদিন ধরেই দেখছি, নানা সময় নাবালক বা পড়ুয়ারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ছেলেমেয়েদের মধ্যে বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা। সমাজের অন্য অংশের সঙ্গেই পুলিশেরও এই বিষয়ে দায়িত্ব রয়েছে।” |
আইজি জানান, আমরা অনেক সময়ই অভিযুক্ত হিসেবে স্কুল পড়ুয়াদের পেলে তাদের ভাল করে বোঝাই। উত্তরবঙ্গেও এমন ঘটনা মাঝেমধ্যে ঘটছে। মাস দু’য়েক আগেই দার্জিলিঙের একটি নামকরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের কয়েকজন পড়ুয়া ড্রাগের ব্যবসা ফেঁদে বসেছিল। খবর পেয়ে আমরা তাদের ধরে বুঝিয়ে শুঝিয়ে ব্যবস্থা নিয়েছি। তার পরে পাহাড়ের স্কুল-কলেজগুলিতে বিশেষজ্ঞ এবং স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে ওয়ার্কশপ, সেমিনার করা হয়। তাতে মাদক-অপরাধ প্রবণতা নিয়ে ছেলেমেয়েদের বোঝানো হয়েছে। আগামীতে উত্তরবঙ্গের ছয় জেলায় পুলিশের পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক প্রচার, সেমিনার করা হবে।তবে পড়ুয়াদের অপরাধপ্রবণতার প্রেক্ষাপট উত্তরে দীর্ঘদিন। ২০০৪ সাল নাগাদ শিলিগুড়ির প্রধাননগরে এক বাইক চোরের দল পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। দেখা যায়, দলের মূল পাণ্ডা একজন কলেজ পড়ুয়া। শুধু তাই নয়, তিনি বিভিন্ন মার্শাল আর্ট প্রতিযোগিতায় অংশও নিয়েছেন। তবে ছ’জেলার সবচেয়ে বড় কলেজ পড়ুয়াদের অপরাধের ঘটনা ঘটে ২০০৮ সালে। শিলিগুড়ির অভিষেক চাচান হত্যার মামলা গোটা রাজ্যে হইচই ফেলে দেয়। এক বান্ধবীকে নিয়ে গোলমালের জেরে অভিষেককে মদ খাইয়ে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়। তার পরে দেহ মোটরবাইকে বসিয়ে শহর থেকে অন্তত ১০ কিলোমিটার দূরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। অভিযুক্ত হিসাবে নাম জড়ায়, তিন ইঞ্জিনিয়ারিং-র ছাত্রেরও। এক ছাড়া ২০১২ বড় বাজার থেকে চুরির অভিযোগে বাগডোগরার একটি নামি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ‘টপার’কে পুলিশ ধরে।
মালদহেই কয়েকমাস আগে সহপাঠীর মোবাইলে অশ্লীল ছবি তুলে ব্ল্যাকমেল করে টাকা ও সোনার গয়না আদায় করতে গিয়ে এক পড়ুয়া ধরা পড়ে। মালদগেরই একটি বড় স্কুলে স্কুলে ধরা পড়ে এক ছাত্রী। যার স্কুল ব্যাগ থেকে মদের বোতালও উদ্ধার হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। উল্লেখযোগ্য, এই ধরণের ঘটনা ছাড়া মাঝেমধ্যেই বাইক চুরি বা শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠছে স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদের মধ্যে। চলতি সপ্তাহেই রায়গঞ্জ আদালতে দুই যুবককে খুনের দায়ে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়েছে। পাঁচ বছর আগে নিজের মেয়েকে ওই সাজাপ্রাপ্তদের উত্যক্ত করার হাত থেকে বাঁচাতে গিয়ে তাদের দুই জনের হাতে খুন হয়েছিলেন, রায়গঞ্জের রূপাহারের বাসিন্দা। ঘটনার সময় ওই যুবকেরা পড়াশুনে ছেড়ে নানা অসমাজিক কাজে জড়িয়ে পড়েছিল বলে অভিযোগ। এখই ভাবে প্রেমে প্রত্যাখিত হয়ে স্কুল ছাত্রীকে প্রকাশ্যে দিনেরবেলায় খুনের ঘটনা ঘটেছে, ফালাকাটা, কোচবিহারেও। প্রতি ক্ষেত্রেই অভিযুক্তরা সদ্য যৌবনে পা রাখা যুবক। তবে মালদহের সপ্তম শ্রেণির খুনের ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছে সকলকেই।
এ দিন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রকে অপহরণ করে খুনের ঘটনায় পুলিশ যে পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে তাদের মধ্যে চার ছাত্রের বাড়ি হবিবপুরের দাল্লা গ্রামে। ওই চার ছাত্রের মধ্যে কেবলমাত্র বিপিন সিকদারের পরিবার সচ্ছল। পাকা বাড়িতে গাড়িও রয়েছে। বাবা মারা যাওয়ার পর ঠাকুমার কাছে মানুষ সে। বড় নাতিকে পুলিশ বৃহস্পতিবার গ্রেফতার করার পর থেকে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন ঠাকুমা বীণাপানি সিকদার। বিপিনের বাড়ি থেকে ৩০০ মিটার এগুলেই অসিত বিশ্বাসের বাড়ি। বিপিন ও অসিত এবছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। অসিতের বাবা ভিন রাজ্যে কাঠের কাজ করেন। তিন ছেলের মধ্যে অসিত মেজ। কাঁদতে কাঁদতে তার মা স্বপ্না বিশ্বাস বলেন, “ওকে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। সঙ্গদোষে ছেলের এই অবস্থা।”
দাল্লা গ্রামের দক্ষিণপাড়ার সুদীপ বসুর বাড়ি। সুদীপের মা পূরবীদেবী জানতেনই না ছেলে কোথায়। সুদীপের বাবা দিনমজুর। বছরের বেশিরভাগ সময়েই জেলার বাইরে থাকেন। পূরবীদেবী বলেন, “ছেলে কলেজ যায়। কলেজে না গিয়ে কী করছে কী করে বলব?” একই পাড়ায় বাড়ি প্রঞ্জয় বিশ্বাসের। সে এ বার পাকুয়াহাট কলেজ বাংলায় তৃতীয়বর্ষের পরীক্ষা দেবে। বাবা মা রংয়ের মিস্ত্রি। অসমে বছরের বেশিরভাগ সময় থাকেন। বড় ছেলে স্নাতক পাশ করে চাকরি জন্য চেষ্ঠা করছে। তাঁদের মেজ ছেলে এ কাজ করবে ভাবতে পারছেন না বাবা প্রমথ বিশ্বাস ও মা অরুন্ধতী দেবীও। বিপিন, অসিত, প্রঞ্জয়, সুদীপ যে স্কুলের ছাত্র সেই দাল্লা চন্দ্রমোহন বিদ্যামন্দিরের প্রধানশিক্ষক জয়দেব লাহিড়ি বলেন, “এরা চার জন গলায় গলায় বন্ধু। একাধিকবার এদের চালচলনের জন্য স্কুলে সতর্ক করা হয়েছিল।”
দার্জিলিং জেলার লিগাল এইড ফোরামের সম্পাদক অমিত সরকারের কথায়, “উত্তরের ছয় জেলায় জুভেনাইল বোর্ডে প্রচুর মামলা হচ্ছে। বেশির ভাগ চুরি, বাইক লোপাট বা শ্লীলতাহানি জাতীয়। ছেলেমেয়েদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। সমাজের প্রত্যেকের দায়িত্ব বিষয়টি নিয়ে সচেতন হয়ে, পড়ুয়াদেরও সচেতন করা।” তবে এই সমস্যার মূলে রয়েছে বর্তমান সময়ে টাকা খরচের অবাধ সুযোগ, এমনটাই মনে করেন জলপাইগুড়ি জেলা হাসপাতালের মনোবিদ স্বস্তিশোভন চৌধুরী। তাঁরা কথায়, “নিত্য নতুন জিনিস, গেজেট বাজারে ছেয়ে যাচ্ছে। টাকা থাকলে সেগুলি হাতে আসছে। বাড়ছে নানা উপায়ে খরচের সুযোগ। আর যখনই টাকায় টান পড়ছে, তখন একাংশ ছেলেমেয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।”
|
(সহ প্রতিবেদন: পীযূষ সাহা) |