অল্প বয়সে এক জন নিজের বিয়ে রুখেছে। অন্য জন বাড়ির কাজে হাত লাগিয়েও পড়াশোনাটা ঠিক চালিয়ে গিয়েছে। কখনও হেঁটে, কখনও সাইকেল চালিয়ে কয়েক কিলোমিটার দূরের স্কুলে ছুটেছে দু’জনেই।
খুকুমণি টুডু আর সুমি মার্ড্ডি। ময়ূরেশ্বর থানার মেটেলডাঙা গ্রামের দুই মেয়ে। আদিবাসী অধ্যুষিত ওই গাঁ থেকে এ বার তারাই প্রথম মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। এ ভাবে ছেলেদেরকেও টেক্কা দিয়ে একটি অজপাড়া গাঁ থেকে ওই দুই মেয়ের এমন উত্থান পথ দেখাচ্ছে পিছিয়ে পড়া আদিবাসী সম্প্রদায়কে। সমাজের একটা অংশের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে মল্লারপুর গার্লস হাইস্কুলের ওই দুই ছাত্রীই এখন গোটা মেটেলডাঙার মুখ হয়ে উঠেছে।
অথচ খুকুমণিদের এই উঠে আসার পথটা কিন্তু সহজ ছিল না। ২০০০ সালে অতি বৃষ্টিতে গোটা গ্রামটাই ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়েছিল। সুমি, খুকুমণিরা তখন চার বছরের শিশু। বাপ-দাদারা ভিটে মাটি সর্বস্ব খুইয়ে আড়াই কিমি দূরের কুমোড্ডা গ্রামে ঠাঁই নিয়েছিলেন। বন্যার পরে মেটেলডাঙা গ্রামকে নতুন করে গড়ে তোলার কাজ শুরু করে স্থানীয় মল্লারপুরের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। গ্রামে ঢোকার রাস্তা মুছে গিয়েছিল। সংস্থার উদ্যোগে মেটেলডাঙা ও আশপাশের কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা মিলে স্বেচ্ছাশ্রমে এক কিমি মোরাম রাস্তা গড়ে তোলেন। এখন গ্রামে বিদ্যুতের আলো, সৌর বিদ্যুৎ এসেছে। গ্রামের পথ ঢালাই হয়েছে। গ্রামের দুই প্রান্তে শিশুশিক্ষা কেন্দ্র এবং অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের নিজস্ব ভবন হয়েছে। গ্রামের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্ক ‘আপনা গাঁও’ হিসাবে মেটেলডাঙাকে ২০০৯ সালে অধিগ্রহণও করেছে। |
(বাঁ দিক থেকে) সুমি ও খুকুমণি। ছবিটি তুলেছেন অনির্বাণ সেন। |
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সম্পাদক সাধন সিংহ ও সভাপতি সোমা পাঠক বলেন, “রাস্তা তৈরির পরে একটি চালাঘরে শুরু করা হয় ‘রাজীব গাঁধী জাতীয় শিশু রক্ষণাগার’। সেখানে গ্রামের শিশুদের পড়াশোনার সুযোগ করে দেওয়া হয়। ২০০৫ সালে আমাদের আবেদনে সাড়া দিয়ে ‘ন্যাশন্যাল সাম্পেল সার্ভে এমপ্লয়িজ কো-অপারেটিভ ক্রেটিড সোসাইটি’র পক্ষ থেকে একটি পাকা ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়।” গ্রামবাসীর সহায়তায় সেখানেই শুরু হয় খুকুমণিদের গড়ার কাজ। আজ, গ্রামের বয়স্ক মহিলা থেকে পুরুষ, সকলেই লেখাপড়ার গুরুত্ব বুঝেছেন। গ্রামের অঙ্গনওয়াড়ি এবং শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে ছোট ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করছে। তাই ওই গ্রামে নতুন করে আর কোনও অল্পবয়সী মেয়ে গ্রাম সংলগ্ন চালকলে কাজ করতে যায় না। গ্রামের ছেলেদের কাছেও সবার আগে গুরুত্ব পাচ্ছে পড়াশোনাই। খুকুমণিদের দেখাদেখি গ্রামের আরও নয় জন মেয়ে ও সাত জন ছেলে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে গ্রাম ছাড়িয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য তিন কিমি দূরের মল্লারপুরের স্কুলে যাচ্ছে।
সকালের রোদে বাড়ির উঠোনে চাটাই পেতে মাধ্যমিকের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল সুমি ও খুকুমণি। দুই বন্ধুর কথায়, “মাঠের কাজে বাবা-মায়ের খাবার নিয়ে যেতাম। গরু-ছাগলও চড়াতাম। কিন্তু পড়তে মন চাইত। তাই অন্যদের থেকে আমাদের বয়স বেশি হলেও পড়াশোনা শেখার তাগিদে শিশু রক্ষণাগারে যেতাম।” গ্রামের ছোট ছোট ভাইবোনেদের সঙ্গে তারাও পড়াশোনা করত। পরে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ শেষ করে দু’জনেই ভর্তি হয় মল্লারপুর গার্লস হাইস্কুলে। সেই শুরু। গ্রাম থেকে সাইকেল চালিয়ে ওরা স্কুলে গিয়েছে। লেখাপড়ার পাশাপাশি স্কুলের খেলাধুলায় জেলাস্তরে খেলেছে। এনসিসি-র প্রশিক্ষণও নিয়েছে। গ্রামের আদিবাসী মেয়েদের নাচের দলের সদস্য হয়ে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অনুষ্ঠানও করেছে। দু’জনেরই এখন স্বপ্ন স্কুল শিক্ষিকা হওয়া।
এত কিছু করতে গিয়ে কখনও কোনও বাধার মুখে পড়তে হয়নি?
হাসি মুখে সুমি বলল, “সেভেনে পড়ার সময় বাড়ি থেকে বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিল। কিন্ত মল্লারপুরের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আমাদের নিয়ে গ্রামে একটি ‘টিন ক্লাব’ গড়েছিল। সেখানে নেহেরু যুবকেন্দ্র থেকে বয়ঃসন্ধিকালের নানা সমস্যা নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। আমরা জেনেছিলাম কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে দিলে শারীরিক, মানসিক ও পারিবারিক কী কী সমস্যা হতে পারে।” সে কথা বাড়িতে জানিয়ে বিয়েটা আটকে ছিল সুমি। তারপর থেকে পড়াশোনাতেও কোনও বাধা আসেনি। সুমির চার ভাইও স্কুলে পড়ে। সুমির বাবা ও মা চাষের কাজে ব্যস্ত থাকায় বাড়িতে ছিলেন না। সুমির দাদু ষাটোর্ধ্ব গুঙরু মার্ড্ডি বললেন, “অল্প বয়সে বিয়ে দিতে গিয়ে পড়াশোনাটা ছাড়িয়ে দিতে হত। ভুল বুঝেছিলাম। নাতনি আরও পড়তে চাই। ও পড়াশোনাটাই চালিয়ে যাক।” অন্য দিকে, খুকুমণির দাদা বিন্দু টুডু বললেন, “গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ৩ কিমি দূরের হাইস্কুলে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। চাষের কাজে বাবাকে সাহায্য করতে পড়াশোনা ছাড়তে হয়। তবে, আমার বোন যখন পড়তে চাই, তখন ও যত দূর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাইবে আমরা ওর পাশে থাকব।”
গ্রামের ওই শিশু রক্ষণাগারের এখন দেখভাল করেন স্থানীয় সোঁজ গ্রামের স্নাতক যুবক রবিলাল মুর্মু। তিনি বললেন, “সুমি আর খুকুমণি আমার কাছে এখনও পড়ে। ওরাই গ্রামের ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রথম মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসে ইতিহাস সৃষ্টি করতে চলেছে। গোটা গ্রামটাই এখন ওদের দিকে তাকিয়ে।”
বিশ্বভারতীর এডুকেশনাল, ইনোভেশন অ্যান্ড রুরাল রিকন্সট্রাকশনের ডিরেক্টর সবুজকলি সেন বলেন, “আদিবাসীরা এ ভাবে এগিয়ে আসুক।” অন্য দিকে, দু’জনের কথা শুনে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি রাজা ঘোষ বলেন, “ভবিষ্যতে উচ্চ শিক্ষার জন্য টাকার দরকার হলে আমরা সাহায্য করব।” |