শহরের কোলাহল থেকে খানিক দূরে নিরিবিলি ঠিকানা। নিভৃতে যেখানে বলে দেওয়া যায় মনের কথা। নির্জনতার এই আশ্বাস দিত দু’টি গাছ। একটি বট ও একটি কদম। এক রাতে সেখানে কে বা কারা পোস্টার দিয়ে দেয় ‘ভালবাসা চৌপথী’। তার পর থেকে সেই নামেই পরিচিত হয়ে যায় কোচবিহারের জিরানপুর পঞ্চায়েতের চাত্রাচেকাডেরা গ্রামের ওই মোড়। তবে বহু বছর পেরিয়ে ওই এলাকায় এখন বেড়েছে বসতি। সেই পুরনো নির্জনতার আর ঠাঁই নেই সেখানে। তাই সেদিনের ভালবাসা চৌপথী আজ যেন হারাতে বসেছে ভালবাসাই।
কয়েক বছর আগেও ১৪ ফেব্রুয়ারি, ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’-তে দিনভর ভিড় থাকত ‘ভালবাসা চৌপথী’তে। তরুণ-তরুণী থেকে সদ্য স্কুল, কলেজের গণ্ডি পার হওয়া যুগলদের উপস্থিতি নজর কাড়ত পথচলতি আমজনতার। গোলাপ বিনিময় থেকে হরেক উপহার আদান প্রদান চলত কদম আর বটের ছায়ায়। শুধু প্রেম উদযাপনের দিনই নয়, বছরের যে কোনও দিনেও এমন দৃশ্য ছিল স্বাভাবিক। জিরানপুরের ‘ভালবাসা চৌপথী’ আজও রয়েছে। তবে সেখানকার সেই কদম গাছ এখন আর নেই। বছর সাতেক আগে অবশ্য ঝড়ে কদম গাছটি উপড়ে যায়। বট গাছটি থাকলেও সেটিও যেন নিঃসঙ্গ। জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় লাগোয়া এলাকায় বেড়েছে জনবসতি। তার উপর আধুনিকতার ছোঁয়ায় শপিং মল, পার্ক, ইন্টারনেট কিংবা মোবাইলে মজেছে তরুণ প্রজন্ম। তাই একসময়ের প্রেমের আশ্রয় হয়ে ওঠা ওই মোড় আজ, শুক্রবার প্রেম দিবসে যেন থাকবে খানিকটা জৌলুসহীনই। |
জিরানপুর পঞ্চায়েতের চাত্রাচেকাডেরা গ্রামের ‘ভালবাসা চৌপথী’র এক দিকে দিনহাটাগামী রাস্তা। অন্য দিকে গিয়েছে বলরামপুর রোড। ওই চৌপথীতে মিশেছে নাজিরহাট ও জিরানপুরগামী রাস্তাও। একসময় প্রায় জনমানব শূন্য ওই বট কদমের ছায়ার নীচে পথচলতি অনেকেই একটু জিরিয়ে নিতেন। তাঁদের মধ্যে বড় অংশই ছিল তরুণ-তরুণী। নিভৃত আশ্রয়ে প্রেমের ঠিকানা হিসেবে সেটি পছন্দ করতেন প্রেমিক-প্রেমিকারা। স্কুল বা কলেজ ফেরত প্রেমিকার জন্য অপেক্ষার জায়গা হিসেবেও ক্রমে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। তবে সেই চৌপথীর এখনকার অবস্থা দেখে অবাক হন স্থানীয় বাসিন্দা হিমাংশু রায়। চাত্রাচেকাডেরার বাসিন্দা হিমাংশুবাবু বলেন, “এখনকার মত মোবাইল, যানবাহন, পার্কে যাতায়াত এলাকায় গত দশ বছর আগেও ছিল না। ওই চৌপথী লাগোয়া রাস্তার দু’ধারেও বাড়িঘর প্রায় ছিল না। প্রেমিক-প্রেমিকারা বছরের ওই একটা দিন অন্তত সেখানে একটু নিরিবিলিতে কাটাতে পছন্দ করতেন। তার জেরেই কারা যেন পোস্টার দেয়। সেই থেকে ভালবাসা চৌপথী নামটাই এখন সকলের মুখে মুখে।”
এই চৌপথী থেকেই গড়ে উঠেছে অনেক ঘর। ভূগোলের স্নাতক কৃষ্ণ বর্মন তাঁদের একজন। কৃষ্ণের কথায়, “ভালবাসা চৌপথীতে আড্ডা দিতে গিয়েই প্রথম ভাললাগা। এপ্রিলে ওঁকেই সামাজিক ভাবে বিয়ে করে ঘর বাঁধব। সব ঠিক হয়ে গিয়েছে।”
অনেকে আবার ঘর বেঁধে দিব্যি আছেন। এলাকার বাসিন্দা তপন দাস, শম্পা দাসেরা তাঁদের অন্যতম। তপনবাবু বলেন, “যা পেয়েছি সবটাই ওই চৌপথীর জন্য।” জিরানপুরের বাসিন্দা এক শিক্ষক পার্থপ্রতিম রায় জানিয়েছেন, কোচবিহারের বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকার নামকরণের পেছনে নানা গল্প প্রচলিত রয়েছে। তিনি বলেন, “ভালবাসা চৌপথীর নামকরণটা কিন্তু সার্থক।” বহু প্রেমকেই ঠাঁই দিয়েছে ওই চৌপথি। তবে এখন সে একাকী। নগরায়নের চাপে হারিয়েছে নির্জনতার উষ্ণতা। কোচবিহারের এক বধূ সুভদ্রা রায়ের কথায়, “ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র সকালে ওই চৌপথিতে না গেলে কেমন একটা লাগত। শহরের বাইরে একটু নিরিবিলির সেই জায়গাটা সেই একই দিনে ইদানীং ফাঁকা দেখলে খারাপই লাগে।” |