ধূসর পাহাড়ের গায়ে লেপ্টে থাকা ঘন সবুজ বন। ঝরনার শব্দ ছাড়া অন্য কিছু কানে আসে না। পা দিতেই নড়ে উঠল দোলনা ব্রিজটা। দোলা দিল তিথির মনেও। আজ জয়-তিথির গন্তব্য সুনতালেখোলা।
ঘুরতে যেতে কার না ভাল লাগে। আর যদি সেটা হয় কাছের মানুষকে নিয়ে। তাই ফুল-কার্ড-উপহার পিছনে ফেলে ভ্যালেন্টাইন্স ডে যাপন এখন এই ভাবেই। শুধু জয়-তিথিই নয়, সানি-মেঘনা, অরিত্র-শ্রেয়া বা রঞ্জন-নন্দিনীর মতো যুগলরা এমন দিনের জন্য বেছে নিচ্ছে রকি আইল্যান্ড বা কুঞ্জনগর, রোহিণী বা কালীঝোরা বা কার্শিয়াং। ভিড় বাড়বে কোচবিহারের রসিকবিল, চিলাপাতা, রসমতি ঝিলে। মালদহর জগদীশপুর, আদিনায়ও ভিড় বাড়বে এই দিন।
ভ্যালেন্টাইন্স ডে বলতে এত দিন বোঝাত কার্ড বা ফুল বিনিময় কিংবা ক্যাডবেরি হাতে দেওয়া। নিদেনপক্ষে সিনেমা হলে কিংবা রেস্তোরাঁর চার দেওয়ালের কয়েক ঘণ্টার স্বপ্নবিলাস। ক্রমে সে জায়গাটা নিল জুয়েলারি শপ। কিন্তু আস্তে আস্তে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে মনের মানুষটির হাত ধরে চেনা সীমার মধ্যেই বেরিয়ে পড়ার প্রবণতা। তাতে গা ভাসাচ্ছে তিস্তা, তোর্সা বা মহানন্দা পাড়ের তরুণ প্রজন্মও। |
এক বেসরকারি সংস্থার কর্মী জয়ের কথায়, “কাজের ব্যস্ততার জন্য ওর সঙ্গে ফোনেও রোজ কথা হয়ে ওঠে না। তাই বিশেষ দিনে এ বার সুনতালেখোলাসারাটা দিন যাতে পরস্পরের সান্নিধ্যে থাকতে পারি।” বাজবে না ফোন, নেই শহরের কোলাহলও।
কলেজ পড়ুয়া সানির পছন্দ মূর্তি। বাইকে দু’জনে দিব্যি চলে আসা যায় এখানে। নদীর ধারে গেস্টহাউস। এক দিকে জঙ্গল। পকেট পারমিট করলে রঞ্জন, অরিত্রর মতো যাওয়া যেতে পারে খুটিমারি, রকি আইল্যান্ড বা ঝালং বিন্দুর পথে।
নিজস্ব নির্জনতার ভরপুর খুটিমারি অরণ্যনিবাস। বাংলো থেকে ডান হাতি কাঁচা রাস্তা ধরে এগোলেই বন ছুঁয়ে থাকা ফসলের খেত, ইতস্তত বনবস্তি। যাত্রা শেষে সবুজের মধ্যে সুউচ্চ নজর মিনার। সামনে জলাশয়। নাম তার সুলটুং। জলের বুকে উড়ে এসে বসে বালি হাঁস, ডাহুকের দল। এ পরিবেশ অন্তরঙ্গ মুহূর্তগুলি রঙিন করে রাখে। “এ পরিবেশ নন্দিনীকে ইম্প্রেস করার পক্ষে দারুণ। এ বার এই উপহারটাই সাজিয়ে দেব।” জানাল রঞ্জন।
চাপড়ামারির জঙ্গল চিরে যে পথ চলে গেছে ঝালং বিন্দুর দিকে, সুহানা সফর শুরু সেখান থেকেই। শাল-সেগুনের নাছোড় পথ মন ভাল করার জাদুমন্ত্র। কুমাই থেকে গৈরিবাসের পাকদণ্ডী। নীচে ঝালং উপত্যকা আর রুপোলি ফিতের মতো জলঢাকা নদী। লাটাগুড়ি রিসর্ট ওনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক দিব্যেন্দু দেব বলেন, “ঢুকঢুকি, সুনতালেখোলা, মূর্তি বা রকি আইল্যান্ডে ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে ভিড় বেশিই হয়। দু’তিন বছর ধরে এই প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে।”
শিলিগুড়ির অরিত্র শ্রেয়াকে নিয়ে দিনটা কাটাবে রোহিণীতে। শিমূলবাড়ি টি এস্টেট পেরিয়ে ভুট্টাখেত, পাহাড়িয়া বসতি, রোহিণীর ছোট বাজার। বাঁক ঘুরতে টিলার নীচে থমকে থামা। বাঁধানো জলাশয়ের ধারে সারি সারি বেঞ্চ। পায়ে চলা পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে পাশের টিলায়। টিলার মাথায় জগদম্বা মন্দিরে শপথ বাক্য পাঠ। শেষে চত্বরের দোকানে মোমোয় পেট ভরানো। অরিত্র জানায়, “তিন বছর ধরে দিনটা আমরা বাইরে কাটাই। চেনা মুখগুলি এড়ানো যায়। গত বছর গিয়েছিলাম দুধিয়া গোকুল।” আর শ্রেয়ার কথায়, “এটা এমন উপহার, দু’জনে মিলেই উপভোগ করা যায়।”
পুনিত অগ্রবালের পছন্দ কার্শিয়াং। পেশায় ব্যবসায়ী পুনিত বলেন, “গত বছর হিরের পেনডেন্ট দিয়েছিলাম। এ বার সারপ্রাইজ গিফট, পাহাড়বাস।” বান্ধবী হিমির বক্তব্য, “পুনিত এ বার কোথায় নিয়ে যাবে জানি না, তবে একটা গোটা দিন এক সঙ্গে থাকব ভেবেই অন্য রকম লাগছে।”
সকাল সকাল বেরোতে পারলে দু’জনের হারিয়ে যাবার ঠিকানা হতে পারে ডেলোও। পাহাড়ের ঢালু জমিতে রডোডেনড্রন, ম্যাগনোলিয়া, ক্যামেলিয়া ফুল-মেলা। যে মেঘ মাথার উপরে ছিল, সেই মেঘ নীচ থেকে উঠে এসে ভেসে বেড়ায় চারপাশে। কোথাও পাইন, ফার কিংবা পুনিপারের ঝোপ, গুচ্ছ গুচ্ছ নাম-না-জানা ফুলের বন্যা।
শুধু যে নবীন প্রজন্মরাই এ ভাবে ভ্যালেন্টাইন্স ডে উদযাপন করছে, তা মানতে নারাজ মালিঙ্গার বাসিন্দা বছর আটষট্টির সুবিমল রায়। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সুবিমলবাবু দাম্পত্য জীবন ৩৫ বছরের। স্ত্রীকে নিয়ে যাচ্ছেন জগজীবনপুর। ইতিহাসের ছাত্রী কৃষ্ণার মুখে খুশির আভা বলে দিচ্ছিল জায়গা নির্বাচন করতে তিনি ভুল করেননি। একাদশ শতাব্দীতে তৈরি এই জগজীবনপুর মহাবিহার। এক সময় বৌদ্ধ পণ্ডিতরা এখানে আসতেন। ফেরার পথে সাঁওতালদের দাওয়ায় জিরিয়ে নেবার ফাঁকে স্মৃতিচারণ।
কোচবিহারের রূপম আর পর্ণা পরিকল্পনা করেছে রসিকবিল যাবে। ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে রসিক বিল কেন? রূপমের কথায়, “পাঁচ বছরের এই সম্পর্কে ভ্যালেন্টাইন্স ডে বলতে বুঝতাম ফটো ফ্রেম, টেডি বিয়ার, ফুল, পেন, কার্ড। গত বছর ক’জন বন্ধু বান্ধবীদের নিয়ে উধাও হল। তখনই পরিকল্পনা করেছিলাম দু’জনে। এটা এমন একটা উপহার, যেটা হারিয়ে বা ফুরিয়ে যাওয়ার নয়। সঞ্চিত থাকে স্মৃতির ঘরে, আজীবন।” রসিকবিলে উড়ে এসে বসে কত প্রজাতির পাখি। চিলাপাতার জঙ্গলে সবুজের অভিযান। জিপসিতে চড়ে বানিয়া নদীর সামনের পথ ধরে। জঙ্গুলে পথে হরিণ, বাঁদর, ময়ূরের চকিত দর্শনে সঙ্গীর মুখের অনাবিল হাসিটিই দিনের পরম প্রাপ্তি।
গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হতেই চোখের সামনে অরণ্য-ছায়ার দুর্গ নলরাজার গড়। গাড়ি ঘুরিয়ে কোদালবস্তি ওয়াচ টাওয়ার। সামনে বিশাল জলাভূমিতে পরিযায়ী পাখিদের মুক্তাঞ্চল। নিবিড় হয়ে ওঠা মুহূর্তগুলির গোপনীয়তার প্রতিশ্রুতি দেবে প্রকৃতি। নিরুদ্দেশ যাত্রার তালিকায় রয়েছে রসমতী ঝিলও। পথ গিয়েছে পাতলাখাওয়া জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। গাছগাছালির ছায়া আগলে রেখেছে ঝিলের জল। পাখির মুক্ত ডানার ভিড়ে জলের পাশে, গাছের ছায়ায় ভাল লাগা, ভালবাসার নেশায় বুঁদ হওয়ার ঠিকানা। |