অস্ত্র ব্যবসা সক্রিয়, মহিলা-খুনে ফের উঠছে প্রশ্ন
কৌশিক চৌধুরী • শিলিগুড়ি |
পুলিশের একাংশের নিষ্ক্রিয়তার জন্য শিলিগুড়িতেও বেআইনি অস্ত্রের কারবারিরা অতি মাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শহরের উপকণ্ঠে হাতিয়াডাঙ্গা এলাকায় এক মহিলাকে দিনেদুপুরে ‘সাইলেন্সর’ লাগানো পিস্তল দিয়ে খুনের ঘটনার পরে ওই অভিযোগ আরও জোরদার হয়েছে। বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারে পুলিশি অভিযান তুলনামূলক ভাবে কমেছে বলেই মুড়ি-মুড়কির মতো অস্ত্র ছড়িয়ে পড়ছে কি না সেই প্রশ্নও উঠেছে।
পুলিশ সূত্রের খবর, গত বছর থেকে কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (কেএলও) ধৃত জঙ্গি সদস্যরা ছাড়াও সম্প্রতি ফুলবাড়িতে ধৃত উত্তপ্রদেশের চোরাকারবারীদের জেরা করে ওই আশঙ্কা আরও স্পষ্ট হয়। গত বুধবারও শিলিগুড়ির অদূরে ইস্টার্ন বাইপাস এলাকায় এক মহিলাকে গুলি করে খুন করা হয়েছে, সেখানেও ‘সাইলেন্সর’ লাগানো আধুনিক নাইন এমএম পিস্তল ব্যবহার হয়েছে বলে ইতিমধ্যে তদন্তে সামনে এসেছে।
রাজ্য পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রের খবর, উত্তর পূর্বাঞ্চল থেকে শিলিগুড়ি হয়ে অস্ত্রের কারবার ফুলেফেঁপে উঠছে। উত্তর পূর্বাঞ্চলের মূলত নাগাল্যান্ড, মণিপুর এবং অসম থেকে শিলিগুড়ি হয়ে ওই অস্ত্র আসছে। তেমনই, বিহারের মুঙ্গের থেকে শিলিগুড়ি হয়ে অসমের দিকেও কিছু আগ্নেয়াস্ত্র ঢুকছে। উত্তরের রাজ্যগুলির ছোট ছোট দল বা গোষ্ঠী টাকার অভাবে কম দামের বিহারের ওই অস্ত্রগুলি ব্যবহার করা শুরু করেছে। নির্দিষ্ট কমিশনের ভিত্তিতে এক শ্রেণির ‘ক্যারিয়ার’ ওই আগ্নেয়াস্ত্র গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছেন। পাশাপাশি, বছর দেড়েক আগেও ওই কাজে উত্তরবঙ্গের ‘দালালে’রা ব্যবহার করা হলেও এখন তা বিহার, উত্তরপ্রদেশের মাফিরা নিজেরাই করা শুরু করেছেন। শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার জগমোহন শুধু বলেন, “আমরা সতর্ক আছি। প্রতিটি থানাকে নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে। লোকসভা ভোট আসছে। বেআইনি অস্ত্রের বিরুদ্ধে দ্রুত অভিযান শুরু হবে।” |
চোরাবাজারে অস্ত্রের দাম |
|
এমপি—৫-২ থেকে ৩ লক্ষ।
এইচকে ৩৩—এক থেকে দেড় লক্ষ।
স্টেনগান—৬০-৭৫ হাজার।
একে সিরিজ—৭৫ হাজার থেকে দেড় লক্ষ।
নাইন এমএম —২৫ হাজার থেকে ২৭ হাজার।
সিক্স রাউন্ড পিস্তল—১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার।
সাইলেন্সর—২৫ হাজার।
পাইপগান—৪ হাজার।
কাতুর্জ—২০০ টাকা থেকে তিন হাজার টাকা অবধি।
সূত্র: পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ। |
|
কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য গোয়েন্দা সূত্রের খবর, সাদামাটা ওয়ার সাটার পাইপগান, ছ’রাউন্ডের পিস্তল থেকে শুরু করে শক্তিশালী সাবমেশিন গান (এমপি-৫), এইচকে-৩৩, একে ৪৭ এবং একে-৫৬-এর মত আগ্নেয়াস্ত্র এখন চোরাবাজারে পাওয়া যাচ্ছে। মাত্র চার হাজার টাকা থেকে দেড় লক্ষ টাকার বিনিময়ে সহজেই তা দুষ্কৃতী বা কোনও দলের হাতে পৌঁছচ্ছে। সম্প্রতি নেপাল সীমান্ত থেকে ধৃত কেএলও জঙ্গি প্রাণনারায়ণ কোচ এবং তরুণ থাপাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে। বিশেষত, বাস, ট্রেন এবং প্রাইভেট গাড়িতেও ওই অস্ত্র শিলিগুড়ি দিয়ে উত্তর পূর্বাঞ্চল এবং বিহার, উত্তপ্রদেশের মধ্যে পারপার করা হচ্ছে। তবে পুলিশ এবং গোয়েন্দাদের কাছে অস্ত্র কারবারারের খবর থাকলেও ধরা পড়ছে খুবই কম। সেক্ষেত্রে পুলিশের একাংশের নজরদারির অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
গত মাসে দু’টি বড় অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনাকে ঘিরে চক্রের ছবিটা পুলিশ এবং গোয়েন্দাদের কাছে আরও পরিস্কার হয়েছে। গত ২৭ জানুয়ারি মাসে নদিয়ার কৃষ্ণনগরে শুল্ক দফতর বালুরঘাটের একটি বাস থেকে ৪০টি নাইন এমএম পিস্তল উদ্ধার করে। ধরা পড়ে মালদহের কালিয়াচকের এক বাসিন্দা। তার পরে ৩১ জানুয়ারি ফুলবাড়িতে সেনার পোশাক পরা অবস্থায় উত্তরপ্রদেশ, বিহারের ছ’জন বাসিন্দা বিপুল পরিমাণ গাঁজা-সহ ধরা পড়েন। তাদের হেফাজত থেকে উদ্ধার করা এমপি-৫, একে-৪৭, একাধিক নাইন এমএম, শতাধিক কার্তুজ উদ্ধার হয়।
গত বছর একইভাবে কুমারগ্রামের সংকোশ নদী এলাকা থেকে মাটি খুঁড়ে গোয়েন্দা এইচকে-৩৩ মত অত্যাধুনিক অস্ত্র উদ্ধার করেছিলেন। তবে চক্রের প্রথম হদিশ মিলেছিল শিলিগুড়ি একটি সোনার দোকানে লুঠ এবং কর্মী খুনের ঘটনার তদন্তে। সেবার ২০১১ সালে ভারত-ভুটান সীমান্তের জয়গাঁর বাসিন্দা মহমম্দ জুলৎ-সহ তিনজনকে ধরে দুটি একে সিরিজ, ২ স্টেনগান, ২৪টি নাইন এমএম এবং ২৪টি পিস্তল মিলেছিল। তার পরে কিছুদিন চুপচাপ থাকলেও চক্রটি ফের সক্রিয় হয়েছে বলে পুলিশ জানতে পেরেছে।
রাজ্য পুলিশের কয়েকজন অফিসার জানান, ওই বড় মাপের ঘটনাগুলি ছাড়াও রায়গঞ্জ এবং মালদহে কয়েকমাসে ধৃত দুষ্কৃতীদের কয়েকজনের হেফাজত থেকে যে অস্ত্র মিলেছে তা সবই ওই চোরাপথে এসেছে। একইভাবে চোরাপথে আনা অন্তত ৫০ হাজার টাকা দামের সাইলেন্সর লাগানো নাইন এমএম দিয়েই বাইপাসে মহিলাকে খুন করা হয়েছে। |