প্রাথমিক স্কুল
শিক্ষকেরা প্রশিক্ষণে, পড়ুয়ারা পথের ধুলোয়
ড়ির কাঁটা সবে ২টো ৪০ পেরিয়েছে।
পিয়ালশোল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দরজায় তালা। শিক্ষক নেই। স্কুলে ঢোকার মুখে চড়ানো বালিতে বসে খেলছে চারটি কচি পড়ুয়া।
বৃহস্পতিবার সকালেও কিন্তু স্কুল খোলা ছিল। পড়ুয়ারা এসেছিল। প্রধান শিক্ষক প্রসেনজিৎ মাহাতো একটি ক্লাসঘরে বসে মনোযোগ দিয়ে খাতাপত্রে লেখালেখি করছিলেন। পাশের ঘরেই মেঝেতে খোলা বইপত্র ছড়িয়ে বসে খুনসুটি-গল্পগুজবে মত্ত এক-ক্লাস ছেলেমেয়ে।
ব্যাপার কী?
প্রসেনজিৎবাবু জানান, “স্কুলের অন্য শিক্ষক প্রশিক্ষণে গিয়েছেন, আজ আমি একা।” পড়ুয়া কত? “মোট ২২। কিন্তু আজ ১৫ জন এসেছে।” মিড-ডে মিল? প্রসেনজিৎবাবু আঙুল তুলে রান্নাঘরের দিকে দেখিয়ে দেন, “ওই দিকে রান্না হয়।” রান্না চড়বে না? স্পষ্ট উত্তর মেলে না।
পুরুলিয়ার হুড়া ব্লকের প্রত্যন্ত চাটুমাদার গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা। পিয়ালশোল ছেড়ে এগিয়ে পৌঁছনো গেল দান্দুডি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মোট ৯১ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে হাজির ৬৮ জন। প্রাক-প্রাথমিক থেকে চতুর্থ, মোট পাঁচটি শ্রেণির দায়িত্বে একা কৃত্তিবাস মাহাতো নামে এক শিক্ষক। প্রধান শিক্ষক সুভাষচন্দ্র মাহাতো-সহ বাকি দুই শিক্ষক প্রশিক্ষণে গিয়েছেন। কী পড়া হচ্ছে? প্রথম শ্রেণির অম্বিকা কর্মকার, প্রশান্ত মাহাতোরা হইহই করে বলে ওঠে “বনে থাকে বাঘ”। তত ক্ষণে পাশের ক্লাস থেকে পড়ুয়ারা হইহই করে উঠোনে বেরিয়ে পড়েছে।

দুপুর ২টো ৪০। পড়ুয়ারা পথের ধুলোয়।
পিয়ালশোল প্রাথমিক স্কুলে। ছবি: প্রদীপ মাহাতো।
দুপুর ১টা। মিড-ডে মিলের বিরতি চলছে।
বরিয়ারপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বারান্দায় বসে রাঁধুনির সঙ্গে গল্প করছিলেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দেবদাস মাহাতো। বেশির ভাগ ক্লাসঘর বন্ধ। পড়ুয়ারা বারান্দায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। তুমুল হই-হট্টগোল। দেবদাসবাবু জানান, মোট ৫৭ জন পড়ুয়ার মধ্যে এ দিন এসেছে ৩২ জন। ক্লাসঘরে তালা কেন? “আমার স্কুলের আর এক শিক্ষক প্রশিক্ষণে গিয়েছেন। তাই সবাইকে নিয়ে বারান্দাতেই পড়াচ্ছি।” সকাল থেকে কী পড়া হল? দ্বিতীয় শ্রেণির নির্মল মাহাতো, দুর্যোধন মাহাতো, জগদীশ মাহাতোরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। প্রথম শ্রেণির শ্রীকান্ত সর্দার বা উজ্জ্বল মাহাতোরাও চুপ। রান্নার দায়িত্বে থাকা ননীবালা মাহাতো বলেই ফেলেন, “আজ কিছুই পড়েনি বোধ হয়। নইলে বলতে পারছে না কেন?” দেবদাসবাবু তড়িঘড়ি বলেন, “দেখছেনই তো কী ভাবে গোলমাল করছে। পড়াবই বা কী করে! ওদের বলেছি, তোরা পড়-লেখ, অঙ্ক করে আমায় দেখা।”
গোটা তল্লাট ঘুরে ২টো ৪০-এ ফের পিয়ালশোল। স্কুলের সামনে রাস্তায় ধুলোবালি নিয়ে খেলতে খেলতেই চতুর্থ শ্রেণির বিবেক মাহাতো, নবকুমার মাহাতো, সঞ্জয় মাহাতো, তৃতীয় শ্রেণির টিঙ্কু মাহাতো জানিয়ে দেয় “স্কুল অনেকক্ষণ বন্ধ হয়ে গিয়েছে, মাস্টারও চলে গিয়েছে।” আজ মিড-ডে মিল হয়নি? “না স্যার!” শুধু আজ নয়, মাঝে-মধ্যেই মিড-ডে মিল হয় না, ফলে দুপুরের খাওয়াও জোটে না জানিয়ে দেয় আশপাশে ভিড় করে আসা আরও কয়েকটি ছাত্রছাত্রী।
স্কুলে মিড-ডে মিল রান্নার দায়িত্বে যিনি, সেই সুন্দরা মাহাতো পাশেই থাকেন। রান্না করেননি? “না স্যার, আজ হয়নি।” কেন? “হেডমাস্টার রান্নার সওদা দেননি, তাই রাঁধতে পারিনি।” কখন ছুটি হল? “ঘড়ি তো দেখিনি, তবে বেশ খানিক আগে।” স্কুলের কাছেই থাকেন গ্রাম শিক্ষা সমিতির সদস্য বাণী মাহাতো। তাঁর কাছে প্রশ্ন ছিল: সাড়ে ১০টায় শুরু হয়ে বিকেল ৪টেয় ছুটি হওয়ার কথা স্কুল। এখন তো মোটে ৩টে বাজে! বাণীদেবী: “কেন বন্ধ, আমি তো জানি না! প্রধান শিক্ষক আমাকে কিছু জানাননি।”
স্কুলের কাছেই দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন তিন-চার জন (তাঁদের কেউ-কেউ পড়ুয়াদের অভিভাবক হওয়ায় নাম দেওয়া হল না)। তাঁরা জানান, প্রধান শিক্ষক প্রসেনজিৎবাবু শুধু শিক্ষক নন, তৃণমূল নেতা তথা স্থানীয় করই মাগুড়িয়া-লালপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধানও বটে। ওই গ্রামবাসী তথা অভিভাবকদের অভিযোগ, পঞ্চায়েতে সময় দিতে গিয়ে প্রসেনজিৎবাবু প্রায়ই দেরিতে স্কুলে আসেন, চলে যান তাড়াতাড়ি। কোনও- কোনও দিন আসেনই না। মিড-ডে মিলের কাজ দেখভালের দায়িত্ব চাপিয়েছেন অন্য শিক্ষকের উপরে। তিনি প্রশিক্ষণে যাওয়ায় হেঁশেল বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
পুরুলিয়া জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (প্রাথমিক) বৃন্দাবন দাস অবশ্য বলেন, “কোনও শিক্ষক প্রশিক্ষণে গেলে পড়ুয়াদের মিড-ডে মিল বন্ধ হবে কেন? এমন তো হওয়ার কথা নয়!” প্রসেনজিৎবাবুর মোবাইলে ফোন করে জানতে চাওয়া হয়, আপনার স্কুলে আজ মিড-ডে মিল হয়নি? আমতা-আমতা করে তিনি বলেন, “না হয়নি।” তার পরেই লাইন কাটে। বারবার চেষ্টা করেও আর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.