অন্তত একটি ক্ষেত্রে ভারত এত দিন বুক বাজাইয়া চিনকে টেক্কা দিত। গোটা দুনিয়ায় আর কোনও দেশ ভারতের ন্যায় সোনা আমদানি করিত না। এমনকী চিনও নহে। সেই গৌরবও অতীত হইল। চিনের সাম্প্রতিক নববর্ষ উত্সবের পর দেখা গেল, এই ক্ষেত্রেও তাহারা দুনিয়ায় এক নম্বর হইয়াছে। হায়! এই পরাজয় ভারতীয় হৃদয়ে শেলসম বিঁধিবে না কি? তবে, হতাশায় নিমজ্জিত হইবার পূর্বে, হে ভারতবাসী, অন্য একটি কথা ভাবিয়া দেখা সম্ভব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে একদা গোটা বিশ্বের অধীশ্বর হইয়াছিল, এমনকী এখনও যে সম্পূর্ণ দুনিয়া স্বেচ্ছায় মার্কিন মুলুকের সাংস্কৃতিক উপনিবেশ হইয়া ভোগে-সুখে কালযাপন করিতেছে, তাহা কি মার্কিন সেনাবাহিনীর দাপটে? ভিয়েতনাম হইতে আফগানিস্তান, গোটা দুনিয়া সমস্বরে বলিবে, সেই মহামহিম বাহিনীরও এহেন ক্ষমতা নাই। মার্কিন যুদ্ধবিমানের যাহা অসাধ্য, কোকা কোলা আর ম্যাকডোনাল্ড, লিভাইস আর অ্যাপ্ল তাহা হেলায় করিয়াছে। ইহা সংস্কৃতির ‘নরম শক্তি’-র বিশ্বজয়। মার্কিন ভোগবাদের সংস্কৃতি এখন দুনিয়ার প্রধানতম জীবনযাপন-অভীপ্সা। বার্গার ও কোলা যেমন মার্কিন সংস্কৃতির দ্যোতক, সোনার হরিণের পশ্চাদ্ধাবন তেমনই ভারতীয় সংস্কৃতির। পঞ্চবটীতে বনবাসকারী এক রাজা তাঁহার স্ত্রীর বাঞ্ছাপূরণে যে দৌড় আরম্ভ করিয়াছিলেন, একুশ শতকেও তাহা চলিতেছে। আর কেহ না জানুন, পালনিয়াপ্পন চিদম্বরম সেই কথা বিলক্ষণ জানেন। ‘সোনার হরিণ চাই’, ভারতের নিজস্ব এই স্লোগানটি কি তবে চিনে তাহার মায়াজাল বিস্তার করিল? তবে কি চিন স্বেচ্ছায় ভারতের সংস্কৃতির অনুগত হইয়া উঠিল? কথাটি উড়াইয়া দেওয়ার নহে। যে প্রবলপ্রতাপশালী চিনের দাপটে হোয়াইট হাউসও ত্রস্ত, ভারতীয় সংস্কৃতির অভিজ্ঞান বহনে তাহার এই আগ্রহ কি ভারতের পক্ষে এক বিপুল গৌরব নহে? সোনা আমদানির দৌড়ে হারিয়া সাংস্কৃতিক উপনিবেশ স্থাপনের লড়াইয়ে জয় হিন্দি ছবির সংলাপ ধার করিলে ভারতকেই বাজিগর বলিতে হয়।
সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের দুইটি পূর্বশর্ত আছে। এক, যে সংস্কৃতি আকর্ষণীয় এবং সহজ, তাহারই বিশ্বায়ন সম্ভব। দুই, সেখানেই বিশ্বায়ন সম্ভব, যেখানে সাধারণ মানুষের চাহিদা দীর্ঘ দিন অবদমিত থাকে। ইন্দিরা গাঁধী এবং অতি অবশ্যই জর্জ ফার্নান্ডেজদের কল্যাণে ভারতের মানুষ কোকা কোলার জন্য চাতকের ন্যায় অপেক্ষা করিয়া ছিলেন। ১৯৯১ তাঁহাদের তৃষ্ণা মিটাইয়াছিল। চিনেও সোনা লইয়া কম হয়রানি হয় নাই। কমিউনিস্টদের নিকট পরাজিত হইয়া জাতীয়তাবাদীরা তাইওয়ানে পলায়নের সময় বহু মানুষের সোনা দখল করিয়া লইয়া গিয়াছিলেন। যতটুকু অবশিষ্ট ছিল, তাহা কমিউনিস্ট পার্টির জঠরে গিয়াছিল। বিদেশি মুদ্রার অভাবে চিন যখন কাহিল, তখন সে দেশের সরকার ব্যক্তিগত সোনার উপর কার্যত নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়াছিল। রাষ্ট্রের নির্দেশ অমান্য করিবার সাহস এবং মানসিকতা চিনের বেশির ভাগ মানুষেরই নাই। ফলে, সোনা কিনিবার, রাখিবার ইচ্ছা মনে চাপিয়া রাখাই একমাত্র পথ ছিল। অন্তত দেং জিয়াওপিং-এর জমানার পূর্বাবধি। কমিউনিস্ট চিনের অভ্যন্তরে বাজারের বিকাশ সে দেশের গল্পটিকে বদলাইয়া দিয়াছে। বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারের নিরিখে চিন দুনিয়ার এক নম্বর। সাধারণ্যের সোনা লইয়া রাষ্ট্রের আর মাথাব্যথা নাই। বাজারের আকাশে চিনের স্বর্ণবাসনার মুক্তি ঘটিয়াছে। মানুষ আশ মিটাইয়া সোনা কিনিতেছেন। রাষ্ট্রও। এক নম্বর হওয়া ঠেকায়, সাধ্য কাহার! |