প্রবন্ধ ...
সামর্থ্য অনেক, তা যথেষ্ট কাজে লাগে না
কুচলি ২-এর আদিবাসী পাড়ায় একশো দিনের কাজের প্রকল্প সম্পর্কে খোঁজখবর করলাম। গ্রামের মানুষ তাঁদের জব কার্ড এনে দেখালেন। কোনও কার্ডে কিছু লেখা নেই, কিন্তু ওঁদের কয়েক জন কাজ করেছেন। (জব কার্ডে ‘জাস্ট’ লেখা হয় না।) ওঁদের মধ্যে এক জন মহিলা জানালেন, মাস তিনেক আগে তিনি এন আর ই জি এ’তে ন’দিন কাজ করেছেন। ন’দিনে ১,২২৫ টাকা রোজগার করেছেন। তার মানে দৈনিক ১৩৬ টাকা। (পরে গ্রাম পঞ্চায়েতের অফিসে মজুরির যে হিসেব দেখেছি, তার সঙ্গে এটা সামঞ্জস্যপূর্ণ।) এই এলাকায় খেতের কাজে মজুরি কত? ওঁরা বললেন, দৈনিক ১৮৫ টাকা, ছেলেদের এবং মেয়েদের মজুরি সমান। তবে চাষের কাজ করতে হয় সাড়ে সাত ঘণ্টা (আটটা থেকে একটা, আবার আড়াইটে থেকে পাঁচটা), আর এন আর ই জি এ’র কাজ হয় চার ঘণ্টা (আটটা থেকে বারোটা)। এবং, কাজ করার পরে মজুরি পেতে দু’মাস সময় লেগেছে। (কুচলি ১-এও একই কথা শুনেছি।) আদিবাসী মেয়েটি জানালেন, তাঁর টাকা আসে ডাকঘর মারফত, কিন্তু তিনি নিজে সেখানে যান না। ‘সুপারভাইজর’ তাঁর টাকাটা তুলে আনেন, তিনি কেবল টাকা তোলার কাগজে টিপছাপ দেন। তিনি লেখাপড়া শেখেননি, তাই কী করে নিজের টাকাটা তুলতে হয় সে-সব তিনি জানেন না।
এখানেও দেখলাম, লোকে জানেন না, একশো দিনের কাজের প্রকল্পে তাঁদের কী অধিকার, কতটা প্রাপ্য।

একশো দিনের কাজ। কৃষ্ণনগর, নদিয়া। ডিসেম্বর ২০১৩। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
আদিবাসী পাড়ায় যাঁদের সঙ্গে কথা বললাম, তাঁদের কেউ পেনশন পান না, যদিও বেশ কয়েক জন বিধবা এবং বয়স্ক মানুষ ছিলেন। গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসে পেনশনের ব্যাপারে খোঁজ নিলাম, কিন্তু খুব একটা নির্ভরযোগ্য তথ্য পেলাম না। (ওঁরা বললেন, চারশো জন মাসে সাড়ে সাতশো টাকা পেনশন পান।) কুচলি ১-এ ফিরে গিয়ে স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যকে বললাম এমন কারও সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে যিনি পেনশন পান। এক বৃদ্ধার সঙ্গে কথা হল, তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে চারশো টাকা পেনশন জমা পড়ে। বৃদ্ধা তাঁর পাসবই দেখালেন। হিসেবপত্র ঠিকঠাক, কিন্তু নিয়মিত টাকা তোলা হয় না, কখনও এক মাসের টাকা দেওয়া হয়েছে, কখনও বা ছ’মাসের টাকা একসঙ্গে, এবং সব সময়েই নির্ধারিত দিনের কয়েক মাস পরে দেখলাম তিনি শেষ পেনশনের টাকা পেয়েছেন অগস্ট মাসে। জানা গেল, ব্যাঙ্ক সেখান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে, সাধারণত কয়েক জন একসঙ্গে একটা ভ্যান রিকশা গোছের কিছু ভাড়া করে পেনশন তুলতে যান। বৃদ্ধাও সে ভাবে যান, তবে টাকা তোলার স্লিপ লেখার জন্য অন্য কারও সাহায্য নিতে হয়, তাঁকে স্লিপ পিছু দশ টাকা দিতে হয়। পাসবই দেখে বুঝলাম, পেনশনের টাকা জমা পড়ার অল্প দিনের মধ্যেই তিনি পুরো টাকাটা তুলে নেন।
এ বিষয়ে প্রায় নিশ্চিত হলাম যে, গ্রাম পঞ্চায়েত অফিস থেকে পাওয়া মাসে সাড়ে সাতশো টাকা পেনশনের হিসেবটা ভুল (পেনশনের টাকা সরাসরি ব্যাঙ্কে জমা পড়ে, ফলে যাচাই করা সহজ), তবে এটা ঠিকই যে, পেনশন প্রাপকের সংখ্যা শ’চারেক হওয়া সম্ভব। তবে একটা অন্য হিসেব দেখা যেতে পারে। ওই গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় প্রায় ৩১০০০ মানুষের বাস, সেই অনুপাতে ৪০০ সংখ্যাটা খুবই কম বলতে হবে।

আমরা কঙ্কালীতলায় গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসে অল্প সময়ের জন্য গেলাম। বাড়িটা বিশাল (ঝাড়খণ্ডে আমার দেখা যে কোনও বিডিও অফিসের চেয়ে বড়), বেশ নতুন, তৈরি করতে সম্ভবত অনেকটা খরচ হয়েছে, অফিসের সাজসরঞ্জাম ভালই আছে, অনেকগুলো অফিসঘর, কম্পিউটার, ফাইল, শেল্ফ ইত্যাদি, রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকঠাক, অন্তত এখনও পর্যন্ত।
প্রথমে গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানের সঙ্গে দেখা করলাম। মহিলা একটা বড়সড় ডেস্কের ও-পারে বেশ ভারিক্কি চালে বসেছিলেন, সামনে কয়েকটি চেয়ার, ডেস্কটি ফাঁকা, চেয়ারগুলিও ফাঁকা। কথা বলে মনে হল, তাঁর পেনশনের ব্যাপারে কিছুই জানা নেই। তিনি ‘সেক্রেটারি’কে ডাকলেন। ভদ্রলোক ইংরেজিতে কথা বললেন, বেশ লেখাপড়া-জানা মনে হল। তিনি আমাদের মূল অফিসে নিয়ে গেলেন জিপি অফিসে এগারো জন কর্মী, তাঁদের মধ্যে ‘এঞ্জিনিয়ার’, কম্পিউটার অপারেটরও আছেন।
অফিসের কর্মীরা পেনশনের ব্যাপারে বিশেষ কিছু জানেন না, তবে এন আর ই জি এ সংক্রান্ত প্রচুর তথ্য তাঁদের কাছে আছে, সবটাই কম্পিউটার প্রিন্টআউট। তাঁরা আমাকে বিশদ হিসেবনিকেশ, এমনকী নানা টেকনিকাল নথিপত্রও দেখালেন। দেখে খুবই ভাল লাগল, কিন্তু তার কতটা প্রকৃত হিসেব, সে বিষয়ে যথেষ্ট সংশয় থেকে গেল।
ওঁরা বললেন, একশো দিনের কাজের প্রকল্পে মজুরি চোদ্দো দিনের মধ্যে দেওয়া হয়। কিন্তু কুচলিতে যা শুনেছি, তার সঙ্গে এ-কথা একেবারেই মিলল না। এন আর ই জি এ’র মোট খরচের যে হিসেব ওঁরা দিলেন, তা বরং অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য: ২০১৩’র এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরে খরচ হয়েছে চার কোটি টাকা। ওঁদের হিসেবে, ওই গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় চার হাজার মানুষের জব কার্ড আছে, তাঁরা এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে গড়পড়তা ৩৫ দিন কাজ পেয়েছেন। এমনিতে মজুরির হার দৈনিক ১৫১ টাকা, তবে যেহেতু কাজের পরিমাণের ওপর প্রকৃত পাওনা নির্ভর করে, তাই কার্যক্ষেত্রে মজুরির হার নানা জায়গায় নানা রকম ওঁদের তথ্য অনুযায়ী কঙ্কালীতলায় দৈনিক গড় ১৩১ টাকা, বোলপুর ব্লকে ১৩৮।
২০১৪’র জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে ওঁরা এন আর ই জি এ’তে ৫৭টি প্রকল্প করতে চান (আমাকে তার বিশদ পরিকল্পনা দেখালেন)। পুকুর কাটা, রাস্তা সারানো, খেলার মাঠ তৈরি করা ইত্যাদি নানা ধরনের প্রকল্পই এর মধ্যে আছে। এন আর ই জি এ’র বেশির ভাগ কাজই গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে ঠিক হয়, তবে প্রজেক্ট অফিসারের একটা অনুমোদন লাগে। মজুরি দেওয়া হয় গ্রাম পঞ্চায়েতের বাজেট থেকেই। ওঁরা জানালেন, প্রকল্পের টাকা নিয়ে কোনও অসুবিধে হয় না।

কুচলিতে কোনও স্বাস্থ্য কেন্দ্র নেই, তাই আমরা গেলাম শাহাজাপুরে। (এই গ্রামটি বোলপুর থেকে কুচলি যাওয়ার পথে মোটামুটি মাঝামাঝি জায়গায় পড়ে, রাস্তার ধারেই। এই গ্রামটিতেও অমর্ত্য সেন এবং সুনীল সেনগুপ্ত সমীক্ষা করেছিলেন।) সিয়ান-মল্লিক গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার এই গ্রামে একটি হেল্থ সাবসেন্টার বা উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। সাবসেন্টারটি একটি দোতলা বাড়িতে, অনেকটা জায়গা আছে। একতলায় স্বাস্থ্য কেন্দ্র, দোতলায় এ এন এম’দের (অক্সিলিয়ারি নার্স মিডওয়াইফ) থাকার জায়গা, তবে এখানে দু’জন এ এন এম-এর বাড়িই কাছে, তাই দোতলাটা ফাঁকা পড়ে আছে। একতলায় কয়েকটি ঘর: সার্জারি, স্টোররুম, ডেলিভারি রুম (আপাতত ব্যবহার করা হয় না), চেক-আপ রুম, টয়লেট ইত্যাদি।
আমরা পৌঁছলাম বেলা বারোটা নাগাদ। দু’জন এ এন এম-এর এক জন সার্জারিতে বসে খাতাপত্র ঠিকঠাক করছিলেন। কোনও রোগী দেখলাম না। তিনি জানালেন, সপ্তাহে গড়পড়তা জনা পঞ্চাশেক রোগী আসেন, তবে এই দিনটাতে রোগী বিশেষ হয় না (কেন, সেটা তাঁর কথা থেকে ঠিক ধরতে পারলাম না)। দেখেশুনে মনে হল, সাবসেন্টারটি প্রধানত এ এন এম’দের একটা ‘বেসক্যাম্প’ হিসেবে কাজে লাগছে। এ এন এম মেয়েটির খুব ভাল ব্যবহার। মনে হল, বেশ কাজেরও। (তিনি গ্র্যাজুয়েট, সিয়ানের ‘মহকুমা হাসপাতাল’-এ দেড় বছর প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।) স্বচ্ছন্দ ভাবেই সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন। কথা বলে মনে হল, নিজের কাজে বেশ মন আছে। এই সাবসেন্টারটি ন’টি গ্রামের জন্য, সব মিলিয়ে ১০,৫০০ মানুষের বাস। গ্রাম পঞ্চায়েতে একাধিক সাবসেন্টার থাকে, সেগুলির তদারকির জন্য থাকেন এক জন ‘সুপারভাইজর’।
দু’কিলোমিটার দূরে সিয়ানের মহকুমা হাসপাতাল ছাড়া বোলপুরে একটি জন স্বাস্থ্য কেন্দ্র (পাবলিক হেল্থ সেন্টার বা পি এইচ সি) আছে, তবে আমার ধারণা এই সাবসেন্টারটি দশ-বারো কিলোমিটার দূরের সুপুর আর একটি পি এইচ সি’র সঙ্গে যুক্ত।
সাবসেন্টারে কী ধরনের পরিষেবা দেওয়া হয় জানতে চাইলে এ এন এম যে তালিকাটি দিলেন, তা হল: অন্তঃসত্ত্বাদের পরিচর্যা (যেমন প্রেগন্যান্সি যাচাই, টিকা, রক্তপরীক্ষা), সন্তান জন্মের পরবর্তী পরিচর্যা, পরিবার পরিকল্পনা (আই ইউ ডি সহ), পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের পরিচর্যা (যেমন টিকা, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ভিটামিন), প্রয়োজনে রোগীকে (বোলপুর জন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে) ‘রেফার’ করা, জননী সুরক্ষা যোজনা, ন’জন ‘আশা’ কর্মীর (ন’টি গ্রামের প্রত্যেকটিতে এক জন) সঙ্গে সমন্বয় রাখা এবং ‘ডটস’ ও কুষ্ঠ নিবারণের মতো কর্মসূচি। এখানে রোগী ভর্তি করার কোনও ব্যবস্থা নেই।
(আগে মেয়েদের এই সাবসেন্টারে এসে জননী সুরক্ষা যোজনার টাকা নিতে হত, এখন যেখানে সন্তান প্রসব করেন সেখানেই তাঁরা টাকাটা নিতে পারেন।)
কী কী ওষুধ বিনা পয়সায় দেওয়া হয়, এ এন এম আমাকে তার একটি তালিকা দিলেন। প্রধানত প্যারাসিটামল, দু’এক রকমের অ্যান্টিবায়োটিক, ওআরএস, হজমের ওষুধ। বড়দের পাশাপাশি শিশুদের জন্যও। সাবসেন্টারে চাইলে এ-সব ওষুধ পাওয়া যায়।

এ এন এমদের একটা সাপ্তাহিক রুটিন আছে:
সোমবার: এক জন সাবসেন্টারে ডিউটিতে থাকবেন, অন্য জন গ্রামে যাবেন
মঙ্গলবার: দু’জনের ভূমিকা উল্টে যাবে
বুধবার: দু’জনেই সাবসেন্টারে থাকবেন
বৃহস্পতিবার: দু’জনেই বাইরের ক্যাম্পে যাবেন (টিকা দেওয়া ইত্যাদি কাজে)
শুক্রবার: এক জন সাবেন্টারে, অন্য জন গ্রামে
শনিবার: মিটিং (বিভিন্ন সপ্তাহে বিভিন্ন জায়গায়, যেমন বোলপুর পিএইচসি, সহজপুর সাবসেন্টার ইত্যাদি)
সমস্যার কথা জিজ্ঞাসা করায় এ এন এম বললেন, সাধারণত হাজার পাঁচেক মানুষের জন্য একটা সাবসেন্টার হয়, সেই হিসেবে এই কেন্দ্রটির ওপর চাপ বেশি। তবে আশা কর্মীদের নিয়ে তিনি খুবই সন্তুষ্ট, তাঁরা কাজে যথেষ্ট সাহায্য করেন। তাঁর যা প্রাপ্য, সেটা সময় মতো পান।
সব মিলিয়ে ঠিকঠাকই লাগল। কেবল একটাই খটকা আমরা যতক্ষণ ছিলাম, এক জন রোগীও দেখলাম না।

খারাপ রাস্তা, সরকারি পরিবহণের দুর্দশা।
গ্রামগুলিতে নানা ধরনের কাজের সুযোগ নেই।
সাধারণ ভাবে পরিকাঠামো দুর্বল।
দরিদ্র, বিশেষত জনজাতির মানুষদের ক্ষমতার অভাব।
গ্রাম পঞ্চায়েতের কাজ করার বিরাট সামর্থ্য, কিন্তু তা ঠিক ভাবে কাজে লাগানো হয় না।
উত্তরপ্রদেশের তুলনায় মেয়েদের সামগ্রিক অবস্থান অনেক ভাল; সক্রিয় এবং উত্‌সাহী অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা এ বিষয়ে বড় ভূমিকা নেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.