|
|
|
|
ভালবাসার যুদ্ধে হারতে নারাজ ‘অন্য রকম’ ওঁরা
পরমা দাশগুপ্ত ও সুচন্দ্রা ঘটক |
সমাজ যাঁদের ‘অন্য রকম’ বলে, যাঁদের সম্পর্কের মধ্যে আইনের অনুশাসন বেঁধে দিয়েছে আদালত, এ বারের প্রেমদিবস তাঁদের কাছে ঠিক কেমন? একান্তে ভালবাসায় ভেসে যাওয়ার? নাকি প্রকাশ্যে প্রেমের বাঁধ ভাঙার?
অন্যান্য বছরেও ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র উদ্যাপনে মাতেননি, এমনটা নয়। আর পাঁচ জন প্রেমিক-প্রেমিকার মতো ওঁরাও দিনটা পালন করেছেন নিজের মতো করেই। কিন্তু ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা নিয়ে চলতে থাকা সাম্প্রতিক বিতর্কই ফের ভাবাচ্ছে ওঁদের। আর তাই কেউ বাছছেন সোচ্চার প্রতিবাদের পথ, কেউ বা আইনের মারপ্যাঁচকে তোয়াক্কা না করে এ বারও বিশেষ দিনটা কাটিয়ে দিতে চাইছেন নিজের মতো করে। কেউ আবার মনে করছেন দিনটাকে নতুন নিরিখে দেখার সময় এসেছে।
ভাষাতত্ত্বের শিক্ষক সৌরভ চক্রবর্তী সমকামী। প্রেমের প্রকাশ নিয়ে বাড়াবাড়িতে বিশ্বাসী নন মোটেই। তবে এখন মনে করছেন, “৩৭৭ ধারা যতটা না সমস্যার, সমাজের চোখরাঙানি বরং তার চেয়ে বেশিই সমস্যার। বরং যদি ভালবাসার পুরুষকে নিয়ে একটা দিন নিজেদের সম্পর্কটাকে সর্বসমক্ষে আনি, তার ভাল দিকও থাকতে পারে। যে কোনও প্রতিবাদেই একটু বাড়াবাড়ি প্রয়োজন।” একইসঙ্গে সৌরভ বলছেন, “আসলে এটা একটা ফ্যালাসি। আইনের সম্মতি না থাকলে সমকামীদের প্রতি সমাজের কড়া অবস্থানটা থেকেই যাবে। আবার সমাজ না মানলে, আইনের স্বীকৃতি আসবেই বা কোথা থেকে?”
ভালবাসার প্রদর্শনে বিশ্বাস করেন না এফ এম চ্যানেলের কর্মী অরিজিত্ মণ্ডল এবং তাঁর সঙ্গী অর্ণব ঠাকুরও। সমকামিতার অধিকারের লড়াইয়ে প্রেমদিবসকে হাতিয়ার করতেই হবে, এমনটাও মনে করেন না। অরিজিত্ বলেন, “সমকামীদের আড়াল ছেড়ে বেরোনোর সময়ে এসেছে। বাধা দিয়ে বা আইন করে কোনও কিছুর উদ্যাপন আটকানো যায় না। প্রকাশ্যেই হোক বা অলক্ষে, এই দিনটা পালন করা দু’জন মানুষের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তবে আমরা যে প্রান্তিক মানুষ নই, এটা নিজের ভিতরে গেঁথে ফেলতে পারলে উদ্যাপন প্রকাশ্যে হল না
আড়ালে, তা নিয়ে আলাদা করে মাথাব্যথা থাকে না।”
পদার্থবিদ্যার গবেষক দেবরাজ রায়ও সমাজের চোখে ‘অন্য রকম’। তাঁর বক্তব্য, ৩৭৭ ধারা আপত্তি তুলেছে শুধু বিশেষ একটি যৌন ক্রিয়া নিয়ে। কিন্তু তাকে ঘিরে চোখরাঙানির গণ্ডীটা বেড়ে গিয়েছে অনেকখানি। সমকামী মানুষদের যাবতীয় আচরণ বিচার হচ্ছে শুধু এই ধারাটাকে হাতিয়ার করেই। দেবরাজ বলেন, “পছন্দের পুরুষবন্ধুর সঙ্গে প্রেমদিবসে বেড়াতে যাব না খেতে যাব, সেটাও যেন এই গণ্ডীর ভিতরে ঢুকে পড়েছে। আসলে তা তো আমার একান্ত ব্যক্তিগত। সমকামী সম্পর্ককে নিচু নজরে দেখার প্রবণতা রয়েই গিয়েছে।”
আদালত কী রায় দিল, তা নিয়ে ঘরের কোণে গুমরে বসে কাটাতে রাজি নন লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল এবং ট্রান্সসেক্সুয়াল (এলজিবিটি)-দের অধিকার নিয়ে লড়াই করা সংগঠন ‘স্যাফো ফর ইকোয়ালিটি’র সদস্য মেঘ। বললেন, “বাকিদের মতো আমারও ভাল লাগার ছোট্ট ছোট্ট অনুভূতি আছে। সেগুলো যথেষ্ট স্বাভাবিক। কিন্তু সেগুলো ভাগ করে নিতে ভালবাসি আমার প্রিয় নারীর সঙ্গেই। আইনি স্বীকৃতি পাচ্ছি না বলে দুঃখ করে বসে থাকব নাকি? আমরা দুই বান্ধবীই তো এ বছর ভ্যালেন্টাইন্স ডে কাটাব কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখে!”
এ বছরের উদ্যাপন ভাবাচ্ছে ডিজাইনার জুটি দেব আর নীলকেও। দেব যেমন বলছেন, “দিনদিন ধর্ষণ বেড়ে চলেছে, আইন বরং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক, ভালবাসার অধিকারের শত্রু না হয়ে। ৩৭৭ ধারা তো শুধু এলজিবিটি-দের সমস্যা নয়। সকলের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। কিন্তু যে ভাবে এলজিবিটি-দের বিরুদ্ধে তাকে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটা ভুল।” সমস্যাটা আরও একটু ব্যাখা করতে গিয়ে নীল বলছেন, “৩৭৭ ধারা শুধু তো যৌনতা সংক্রান্ত বিষয়ে আপত্তি তুলেছে। তবে ভালবাসা মানে শুধু তো যৌনতা নয়। ভ্যালেন্টাইন্স ডে যদি আমরা ভালবাসার অধিকার চেয়ে পালন করি, তাতে আপত্তির কী আছে?”
৩৭৭ ধারা নিয়ে বিতর্কের প্রেক্ষিতে সমকামিতার অধিকারের লড়াইয়ে সামিল বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারাও। তার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনও। ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তেই এই কর্মসূচি নিয়েছেন কলকাতার যাদবপুর-প্রেসিডেন্সি, দিল্লির জেএনইউ-ডিইউ এবং হায়দরাবাদের অম্বেডকর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। উদ্যোক্তাদের তরফে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের স্নাতকোত্তরের ছাত্র অম্লান হাজরা জানান, অ্যাকাডেমির সামনে গান-কবিতা, মিছিলে চলবে তাঁদের প্রতিবাদ আন্দোলন।
দিল্লির কর্মসূচির উদ্যোক্তা, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া দেবায়ুধ চট্টোপাধ্যায় বললেন, “প্রেমের জন্য বিদ্রোহের দিন হিসেবে বেছে নিলাম প্রেমদিবসকেই। আমরা, দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পড়ুয়ারা জড়ো হব পার্লামেন্ট স্ট্রিটে।”
ভালবাসার অধিকার চাওয়া এই অন্য লড়াই, ঘুরেফিরে আসা প্রশ্নগুলো কতটা ভাবাবে সমাজের মাপকাঠিতে চেনা পথের পথিকদের? সেটা অবশ্য সময়ই বলবে। |
|
|
![](http://archives.anandabazar.com/newimages/blank.gif) |
|
|