|
|
|
|
ছুটল ঝাঁঝাঁলো গ্যাস, ভেঙে চুরমার ল্যাপটপ
শঙ্খদীপ দাস • নয়াদিল্লি
১৩ ফেব্রুয়ারি |
সংসদে আবার হামলা!
বছর বারো আগে সংসদ চত্বরে ঢুকে হামলা চালিয়েছিল এক দল জঙ্গি। ভারতীয় সংসদের গর্ব ধ্বংস করার সেই ষড়যন্ত্র অবশ্য সে দিন সফল হয়নি। কিন্তু আজ, সংসদের মধ্যে দাঁড়িয়ে সাংসদরাই একে অন্যকে যে ভাবে আক্রমণ করলেন, তার পরে অনেকে বলছেন, ১৩/১২-র জঙ্গি হামলার সঙ্গে অনায়াসেই একাসনে বসানো যেতে পারে এই ১৩/২-কে!
এ দিন কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন সীমান্ধ্রের এক দল সাংসদ। লোকসভায় তেলঙ্গানা বিল পেশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সক্রিয় হয়ে ওঠেন তাঁরা। তুমুল হট্টগোলের মধ্যেই তাঁদের কেউ ছুরিজাতীয় জিনিস উঁচিয়ে হুমকি দিলেন! অন্য জন অতর্কিতে এমন ভাবে মরিচ স্প্রে ছড়িয়ে দিলেন সভাকক্ষে যে, মুহূর্তে লোকসভা পরিণত হল গ্যাস চেম্বারে! তাতে চোখ রগড়ে কাশতে কাশতে লোকসভা থেকে ছিটকে বেরিয়ে যেতে হল একাধিক সাংসদকে। সীমান্ধ্র এবং তেলঙ্গানার সাংসদদের মধ্যে ধস্তাধস্তি, কিল, ঘুষি, গালমন্দও চলল দেদার! যার মিলিত ধাক্কায় একাধিক প্রবীণ সাংসদ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এমনকী অ্যাম্বুল্যান্স ডেকে পাঁচ সাংসদকে হাসপাতালেও নিয়ে যেতে হল!
ভারতীয় সংসদের দীর্ঘ ইতিহাসে এমন ঘটনা অভূতপূর্ব তো বটেই, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, চরম লজ্জাজনকও! হামলাকারী সাংসদদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করার দাবিও তুলেছেন তাঁদেরই একাধিক সতীর্থ! ইতিমধ্যেই ১৬ জন সাংসদকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। পারস্পরিক দোষারোপের পালার মধ্যেও প্রায় সকলেই একবাক্যে বলছেন, সংসদের ইতিহাসে এমন কালো দিন আগে আসেনি। |
|
পেপার স্প্রে-তে নাজেহাল স্পিকার মীরা কুমার এবং এক সাংসদ।
বৃহস্পতিবার সংসদ ভবনে। ছবি: পিটিআই। |
আজ তেলঙ্গানা রাজ্য গঠন বিল পেশের সময় গোলমাল যে হবে, সেই আশঙ্কা ছিলই। গোয়েন্দা তথ্য এ-ও ছিল, সেই বিলের বিরোধিতা করে লোকসভার মধ্যেই গায়ে আগুন দিতে পারেন সীমান্ধ্রের কোনও সাংসদ। তাই মার্শালরা (সংসদের নিরাপত্তা রক্ষীরা) প্রস্তুত ছিলেন আগুন নেভানোর সরঞ্জাম এবং কম্বল নিয়ে। সংসদের মূল ফটক থেকে লোকসভার লবি হয়ে দর্শক গ্যালারি রক্ষীদের সতর্ক চোখ ছিল সর্বত্র।
এমনই পরিবেশের মধ্যে লোকসভার অধিবেশন যখন বসে, তখন রাজ্য অবিভক্ত রাখার দাবিতে সীমান্ধ্রের সাংসদরা এক দফা হট্টগোল করেন। তার ধাক্কায় সভা ১২টা পর্যন্ত মুলতুবি হয়ে যায়। তবে সকলেই জানতেন, আসল গোলমালটা হবে এর পরে! কারণ সরকার জানিয়েছিল, প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হওয়ার পর বিল পেশ হবে ১২টায়। তাই মুলতবি হলেও সীমান্ধ্রের সাংসদরা সভা ছাড়েননি। নিজেদের মধ্যে জটলা করে ফিসফাস-কানাকানি করছিলেন। অনেকেই বলছেন, কংগ্রেস থেকে সদ্য বহিষ্কৃত বিজয়ওয়াড়ার সাংসদ লাগরাপটি রাজাগোপালের চোখমুখ দেখে তখনই গোলমালের আশঙ্কা করছিলেন তাঁরা। সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী তথা কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা কমল নাথের চোখেও তা পড়ে। তাই রাজাগোপালকে ট্রেজারি বেঞ্চের দিকে ডেকে তাঁর সঙ্গে গল্প জুড়ে দেন তিনি। তাঁর হাত ধরে টেনে বসানোর চেষ্টাও করেন। ক্রমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল শিন্দে, অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরমও তৃতীয় সারি থেকে এসে বসেন প্রথম সারিতে। তাঁরাও সীমান্ধ্রের সাংসদদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দেন। ট্রেজারি বেঞ্চের দিকে যখন এই তৎপরতা চলছে, তত ক্ষণে সেক্রেটারি জেনারেলের চেয়ারের পাশে পজিশন নিয়ে নেন তেলুগু দেশম সাংসদ মোদুগুলা বেণুগোপাল রেড্ডি। |
ক্লিক করুন... |
এই সময়ে সংবাদমাধ্যম তো বটেই, সাংসদদেরও অনেকে টের পেয়ে যান যে, এ বারে একটা কিছু হতে চলেছে। ঠিক ১২টায় স্পিকার মীরা কুমারের সভায় প্রবেশের কথা মার্শাল ঘোষণা করতেই প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে ওঠেন বেণুগোপাল। সেই সঙ্গেই মুহূর্তের মধ্যে সেক্রেটারি জেনারেলের টেবিল থেকে ল্যাপটপ তুলে নিয়ে সেটিতে আছড়ে ফেলেন মাটিতে। এক ঝটকায় উপড়ে ফেলেন টেবিলে রাখা মাইক। ক’দিন আগেই বহু কোটি টাকা খরচ করে সংসদে এ সব নতুন শব্দ যন্ত্র বসানো হয়েছে। বিশাল বপু বেণুগোপালকে ততক্ষণে ঘিরে ফেলেছেন রাজ বব্বর, হারুন ইউসুফ, লাল সিংহ-সহ একাধিক কংগ্রেস সাংসদ। স্বল্প সময়ের মধ্যে স্পিকার মার্শাল ডাকার সুযোগ পাবেন না মাথায় রেখে কংগ্রেসের এই সাংসদরা আগে থেকেই ওয়েলে নেমে প্রস্তুত ছিলেন। তবে বেণুগোপাল তাঁর ভারী শরীরের মোচড়ে মুহূর্তে কুপোকাৎ করে ফেলেন হারুনকে। সেই সঙ্গে ছুরিজাতীয় কিছু তুলে ধরে আস্ফালন শুরু করে দেন।
সভার নজর তখন বেণুগোপালের দিকে। আচমকাই দক্ষ কবাডি খেলোয়াড়ের মতো কংগ্রেস সাংসদদের বলয়ের ফাঁক গলে সোজা স্পিকারের আসনের সামনে চলে আসেন রাজাগোপাল। চকিতে পকেট থেকে বের করে ফেলেন একটি লাল রঙের স্প্রে-র ক্যান। সেটি স্পিকারের দিকে তাক করে ছিটিয়েও দেন। কেউ কিছু বোঝার আগেই রাজাগোপাল এ বার ছুটে যান বিরোধী আসনের দিকে। সেখানে সিপিএম নেতা বাসুদেব আচারিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে এলোপাথাড়ি ওই স্প্রে ছেটাতে শুরু করেন। পিছনে দাঁড়িয়েছিলেন প্রবীণ সিপিআই সাংসদ গুরুদাস দাশগুপ্ত। তিনি ভেবেছিলেন, কোনও দাহ্য পদার্থ বোধহয়। কিন্তু দম বন্ধ হয়ে আসতেই তিনি ছুটে বেরিয়ে যান সভা থেকে।
এ সময় তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় ঝাঁপিয়ে পড়েন রাজাগোপালের ওপর। স্প্রে-র ক্যান কেড়ে নিতে সৌগতবাবু-র সঙ্গে যোগ দেন তেলঙ্গানার কংগ্রেস সাংসদ জগন্নাথ। তবে জগন্নাথের চেষ্টা নিরীহ ছিল না। তিনি রাজাগোপালকে যথেচ্ছ ভাবে ঘুষি মারতে থাকেন। পাল্টা ঘুষি চালান রাজাগোপালও।
তত ক্ষণে অনেকেরই ধারণা হয়ে গিয়েছে যে, কিছু একটা গ্যাস ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পরে অবশ্য জানা যায়, ওটি ছিল মরিচ স্প্রে। যা আদতে লঙ্কা থেকে বের করা এক ধরনের রাসায়নিক দিয়ে তৈরি। তারই ঝাঁঝে অস্থির হয়ে পড়েন উপরে প্রেস গ্যালারিতে থাকা সাংবাদিকরাও। চিদম্বরম, শিন্দে, বিরোধী নেত্রী সুষমা স্বরাজরা পড়িমড়ি করে মুখে রুমাল চাপা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যান। সভাকক্ষ জুড়ে কাশির রোল ওঠে। হুড়মুড় করে বেরনোর চেষ্টা করেন সাংসদরা। রাজাগোপাল তখনও নাছোড়। স্প্রে-র ক্যানটি ওখানেই শেষ করে ফেলতে যেন মরিয়া তিনি! এই অবস্থায় তাঁর সঙ্গে তুমুল ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে যায় একাধিক সাংসদের। শেষ পর্যন্ত দশ জন মার্শাল পাঁজাকোলা করে তাঁকে তুলে নিয়ে যান স্পিকারের ঘরে।
রাজাগোপালের ছেটানো স্প্রে-র ধাক্কায় আক্রান্ত মীরা কুমার আগেই সভা ছেড়ে বেরিয়ে যান। পরে সভা মুলতবি হতে দেখা যায় লোকসভার লবিতে বর্ষীয়ান সাংসদদের কেউ হাতে মুখ গুঁজে বসে পড়েছেন, কেউ বা চোখে জলের ঝাপটা দিতে ছুটছেন বাথরুমে। ও দিকে সংসদ চত্বর জুড়ে যেন বারো বছর আগের সেই হামলার দিনটা! নিরাপত্তা রক্ষীরা নেমে পড়েছেন উঠোনে। হুটার বাজিয়ে অ্যাম্বুল্যান্স ঢুকে পড়েছে। ত্রিপুরার সিপিএম সাংসদ খগেন দাস-সহ তিন সাংসদকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। তার পরেই আসে দ্বিতীয় অ্যাম্বুল্যান্স। মাথায় আঘাত লেগে নেতিয়ে পড়া তেলঙ্গানার কংগ্রেস সাংসদ পোন্নম প্রভাকরকে নিয়ে সেটিও রওনা দেয় হাসপাতালের উদ্দেশে। খবর পেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে বিপর্যয় দমন শাখার কর্মীরা গ্যাস মাস্ক পরে লোকসভায় ঢুকে পরীক্ষা চালান। রাজাগোপালের ছেটানো স্প্রে-র প্রকোপ এতটাই তীব্র ছিল যে তা সংসদের সেন্ট্রাল হল পর্যন্ত ছড়ায়। সেখানেও কাশতে কাশতে হয়রান হন সাংসদরা। শেষ পর্যন্ত সেন্ট্রাল হলের সব দরজা খুলে দেওয়া হয়। কংগ্রেসের অনেকেই বলছেন, ভাগ্যিস আজ সভায় ছিলেন না সনিয়া গাঁধী। এমনিতেই তাঁর শরীর কিছুটা খারাপ। তার মধ্যে এই ঝাঁঝালো গ্যাস শরীরে গেলে তিনি হয়তো আরও অসুস্থ হয়ে পড়তেন।
লোকসভার অন্দরে নাটক অবশ্য তখনও থামেনি। দুপুর ২টো নাগাদ ফের শুরু হয় সভার অধিবেশন। এ বার মার্শালরা বেণুগোপাল রেড্ডিকে সভায় ঢুকতে বাধা দিলে তিনি প্রবল চিৎকার জুড়ে দেন এবং তাঁদের ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়েন। এ বার আর কংগ্রেস সাংসদরা ঝুঁকি নেননি। ফুটবলের ম্যান মার্কিংয়ের মতোই সীমান্ধ্রের এক এক জন সাংসদকে ঘিরে রাখেন চার-পাঁচ জন করে কংগ্রেস সাংসদ! তার মধ্যেও রাজ্যভাগের বিরোধিতা করে স্লোগান ওঠে। আচমকাই বুকে ব্যথা নিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েন সীমান্ধ্রের কংগ্রেস সাংসদ কোনাকাল্লা নারায়ণ রাও। মার্শালরা ধরাধরি করে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যান। তবে এরই মধ্যে স্পিকার মীরা কুমার সীমান্ধ্রের ১৪ জন এবং তেলঙ্গানার দুই সাংসদকে সাসপেন্ড করার কথা ঘোষণা করেন।
এই বেনজির কাণ্ড দেখে দলমত নির্বিশেষে নেতারা বুঝে যান, লোকসভা ভোটে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই বিরোধীদের সঙ্গে শাসক দলের সাংসদরাও নিন্দে করতে নেমে পড়েন। সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী কমল নাথ বলেন, “হাতে ছুরি নিয়ে সংসদে প্রবেশ মানা যায় না। বেণুগোপাল ও রাজাগোপালের শাস্তি হওয়া উচিত।” কংগ্রেস সাংসদ সঞ্জয় নিরুপমের দাবি, খুনের চেষ্টার অভিযোগ এনে ফৌজদারি মামলা করা উচিত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে। এঁদের লোকসভা নির্বাচনে লড়া আটকানোর দাবিও ওঠে। বেণুগোপালের দাবি, তিনি ছুরি নিয়ে ঢোকেননি সংসদে। তাঁর হাতে মাইকের উপড়ে ফেলা অংশটি দেখা গিয়েছে। রাজাগোপাল পরে জানান, আত্মরক্ষার তাগিদে ওই স্প্রে ছিটিয়েছিলেন! যদিও আত্মরক্ষার প্রয়োজনের কোনও কারণ জানাননি।
যে যা-ই বলুন, ততক্ষণে ঢি ঢি পড়ে গিয়েছে সর্বত্র। দেশের গণ্ডী ছাড়িয়ে বিদেশেও!
এর পরেও কি বলবেন, এটা সংসদে হামলা নয়? |
|
|
|
|
|