অস্থি বিভাগ নয়, তবু সেখানে রোগিণীর হাতে লাঠি ধরিয়ে দিয়েছেন হাসপাতাল-কর্মীরাই। প্রবল কাশির দমক চেপে বিছানায় বসে রোগিণী লাঠি হাতে ভয় দেখাচ্ছেন মার্জারকুলকে। কলকাতার আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চেস্ট মেডিসিন বিভাগে এটাই চেনা ছবি।
দলে দলে নির্ভয়ে ওয়ার্ডে ঘুরে বেড়ায় বিভিন্ন বয়স ও আকারের বেড়াল। ভয়ে সিঁটিয়ে থাকেন রোগিণীরাই। নিজেদের রোগ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হওয়ার সময় নেই। কখন বেড়াল এসে খাবার খেয়ে যায়, কখন অসাবধানে বেড়ালের ল্যাজে পা দিয়ে ফেলেন, সব সময়ে সেই ভয়েই শশব্যস্ত তাঁরা। অসাবধানতার জেরে বেড়ালের আঁচড়-কামড় খাওয়ার নজির রয়েছে অজস্র। তাই নার্স এবং আয়ারাই রোগিণীদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন ছোট ছোট লাঠি। সেই লাঠি হাতেই চারপাশে খেয়াল রাখতে হয় তাঁদের। কলকাতার অন্যতম প্রধান একটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একটি গুরুত্বপূর্ণ ওয়ার্ডের হাল যদি এমন হয়, তা হলে জেলা বা গ্রামীণ হাসপাতালের হাল কেমন হবে সে প্রশ্ন তুলেছেন রোগীরাই। কর্তৃপক্ষের যুক্তি, বেড়ালের হয়ে সওয়াল করার অনেকে আছে, ব্যবস্থা নিলে বরং হাসপাতালেরই সমস্যা! |
রান্নাঘরের চালে তিন শালিকের ঝগড়া করার গল্পটা চেনা। কিন্তু দিন কয়েক আগে এক বিকেলে ওয়ার্ডে ঢুকতে দেখা গেল, হাসপাতালের বেডে তিন বেড়ালের দিব্যি সহাবস্থান। কে বলে সরকারি হাসপাতালে শয্যার আকাল? সেখানে তো শয্যায় আয়েস করে ঘুমোচ্ছে তিনটে বেড়াল। কয়েক মিনিট পরে তাদের এক জন বালিশের উপরে উঠে হাই তুলতে শুরু করল। তার পরেই শুরু হল তার তারস্বরে চিৎকার। ওয়ার্ডের এক নার্স জানালেন, ঘুম ভাঙার পরে খিদে পেয়েছে। তাই খাবারের ফরমায়েস করেই চেঁচাচ্ছে সে। কয়েক মিনিটের মধ্যে ধরাধরি করে এক তরুণীকে ওই ওয়ার্ডে নিয়ে এলেন এক ব্যক্তি। নার্সদের বললেন, “এঁকে ভর্তি করা হয়েছে। ডাক্তারবাবু আপাতত শুইয়ে দিতে বললেন। একটু পরে এসে উনি দেখে যাবেন।” শুইয়ে দেওয়ার জন্য অন্য কোনও শয্যা তখন খালি নেই। তাই বেড়াল তিনটিকে নামিয়ে সেখানেই রোগিণীর শোয়ার বন্দোবস্ত হল। কাঁচা ঘুম ভেঙে ব্যাজার মুখে মেঝেতে পায়চারি শুরু করল একটি সাদা, একটি পাটকিলে এবং একটি ধূসর রঙা বেড়াল।
এক রোগিণী বলেন, “এক দিন ভিজিটিং আওয়ার শেষ হওয়ার পরে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। খাটের পাশের ছোট টেবিলে বাড়ি থেকে আনা খাবার ঢাকা দেওয়া ছিল। হঠাৎ অন্যদের চিৎকারে ঘুম ভেঙে দেখি, একটা বেড়াল আমার সেই খাবার পরম আনন্দে খেয়ে চলেছে।”
বিভাগের চিকিৎসক-নার্সরাও তিতিবিরক্ত। এক চিকিৎসকের কথায়, “প্রতিদিন সকালে ওয়ার্ডে রাউন্ড দিতে এসে প্রথম কাজ হল বেড়াল তাড়ানো। রীতিমতো হাত-পা ছুঁড়ে তাড়াতে হয়। অথচ কারও এ নিয়ে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই।” নার্সদের একাংশ অবশ্য বেড়ালের উৎপাত বেড়ে চলার জন্য রোগিণীদের একাংশকেও দায়ী করেছেন। তাঁদের বক্তব্য, আহ্লাদ করে বেড়ালকে খেতে দেন অনেকেই। তাই ওদেরও সাহস বেড়ে গিয়েছে। তাড়ালেও চট করে যেতে চায় না।
ফুসফুসের চিকিৎসা বিভাগে অন্যতম শর্তই হল পরিচ্ছন্নতা। সেখানে ঘরময় বেড়ালের আনাগোনা, বাতাসে সব সময়ে উড়ে বেড়াচ্ছে বেড়ালের লোম যার জেরে যে কোনও সময়ে রোগীরা আরও অসুস্থ হয়ে উঠতে পারেন বলে আশঙ্কা চিকিৎসকদেরই। |
কেন এ ভাবে বেড়ালের মৌরসীপাট্টা চলছে আর জি করে? কর্তৃপক্ষের যুক্তি, বেড়াল ধরার কোনও সংস্থা তাঁদের প্রস্তাবে রাজি হচ্ছে না। এক কর্তা বলেন, “এখন তো আবার পশুপ্রেমী সংগঠনগুলির রমরমা। বেড়াল ধরতে গিয়ে সামান্য এ দিক থেকে ও দিক হলে আমাদেরই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।”
বেড়ালদের তরফে সরব হওয়ার জন্য অনেক সংগঠন রয়েছে, রোগীদের জন্য কি তা হলে কেউ নেই? এমনই বেড়াল-রাজত্ব চলতে থাকবে চেস্ট মেডিসিন বিভাগে? হাসপাতালের সুপার দিব্যেন্দু গৌতমকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি প্রতিবেদকের ‘ভুল’ শুধরে দিয়ে বলেন, “শুধু চেস্ট মেডিসিন নয়, গাইনি বিভাগেও প্রচুর বেড়াল। অন্য ওয়ার্ডেও উৎপাত কম নয়।” তা হলে তাঁরা ঠিক কী করছেন? তিনি বলেন, “বেশ কয়েকটা সংস্থাকে বলেছি। কিন্তু কেউ রাজি হচ্ছে না। আপনার সন্ধানে কোনও সংগঠনের হদিস থাকলে দয়া করে বলবেন?” |