কেউ ঘর তৈরি করে দেওয়া হবে জেনে ঘর ভেঙে দিয়েছিলেন। কারও আবার ঘর তৈরি শুরু হলেও অর্ধসমাপ্ত অবস্থাতেই তা ফেলে রেখে চলে গিয়েছে ঠিকাদার। এই অবস্থায় ওই সব আশ্রয়হীন পরিবারগুলির কেউ চলে গিয়েছেন কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে। কারও আবার সে উপায়ও না থাকায় গাছতলাতেই আশ্রয় নিয়েছেন। দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুর-২ ব্লকে ‘আমার বাড়ি’ প্রকল্পে যাঁরা ঘর পেয়েছিলেন তাঁদের অধিকাংশেরই এমনই অবস্থা। এ ব্যাপারে বিডিও ত্রিদিব সর বলেন, “বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখছি। প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১০ সালে আয়লা আক্রান্ত দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ড হারবার মহকুমার মথুরাপুর-২ ব্লকে আমার বাড়ি প্রকল্পে ঘর তৈরি করে দেওয়ার জন্য উদ্যোগী হয়েছিলেন রায়দিঘির তদানীন্তন সিপিএম বিধায়ক তথা সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। ঠিক হয়েছিল সুন্দরবন গ্রামীণ উন্নয়ন প্রকল্পের টাকায় ওই সব ঘর তৈরি করে দেওয়া হবে। সেই অনুযায়ী ওই ব্লকে ৮০০টি বাড়ি তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। প্রতিটি বাড়ির জন্য ১ লক্ষ ৩২ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়। যে পরিকল্পা করা হয়েছিল তা হল, প্রতিটি বাড়ির জন্য ৬টি বিম তৈরি করা হবে। এক একটির উচ্চতা হবে ৫ থেক ৬ ফুট। তার উপরে ছাদ। ছাদে থাকবে দু’টি ঘর ও সংলগ্ন বারান্দা এবং নীচে নামার জন্য সিঁড়ি। বিমের উচ্চতা ৫-৬ ফুট করার কারণ হিসাবে বলা হয় ব্লকটি মনি নদীর লাগোয়া। ফলে বর্ষায় নদীর বাঁধ ভেঙে প্রায় এলাকা প্লাবিত হয়। এ ছাড়া আয়লার মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে কিছুটা রেহাই পেতেই এই ধরনের বাড়ি তৈরির পরিকল্পনা করা হয়েছে। |
প্রকল্পের অনুমোদনের পর কাজও শুরু হয়ে যায়। কিন্তু তার পর থেকেই সমস্যার শুরু। মথুরাপুর-২ পঞ্চায়েত সমিতিতে ক্ষমতায় থাকা তৃণমূল নেতৃত্বের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, এই প্রকল্পে যাঁরা বাড়ি পাবেন নিয়ম মেনে সেই সব বেনিফিশিয়ারিদের তালিকা তৈরি হয়নি। তাঁরা অভিযোগ করেন, বেছে বেছে সিপিএমের কর্মী-সমর্থকদের ওই প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে। এমনকী সিপিএমের বিরুদ্ধে স্বজনপোষণের অভিযোগও ওঠে। ইন্দিরা আবাস যোজনার টাকা পেয়েছেন, চাকুরিজীবী এমন অনেকের নামও তালিকায় থাকার অভিযোগ তুলেছিল তৃণমূল। আর এই অভিযোগকে ঘিরে প্রকল্প নিয়ে শুরু হয়ে যায় রাজনৈতিক টালবাহানা। যার প্রভাবে বহু ক্ষেত্রেই ঠিকাদারেরা নির্মাণ কাজ শেষ না করেই মাঝপথে কাজ বন্ধ রেখে চলে যায়। তার পর থেকে প্রকল্পের কাজ আর এগোয়নি।
অথচ প্রকল্পের কাজ শুরুর আগে সমস্ত বেনিফিশিয়ারিদের বলা হয়েছিল, ঘর তৈরির জন্য জায়গার ব্যবস্থা করতে। সেইমতো অনেকে ঘর পাবেন জেনে পুরনো ঘর ভেঙে ফেলেছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক টানবাহানায় কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেই সমস্ত বেনিফিশিয়ারিরা বিপদে পড়েন। কেউ কেউ ফের ঘর তৈরি করে নিলেও অনেকেই আর তা না পেরে আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। এমনই ছবি দেখা গিয়েছে, এই ব্লকের নগেন্দ্রপুর পঞ্চায়েতের দমকল চ্যাটার্জি পাড়া, পুরকাইত পাড়ায়। পুরকাইত পাড়ার মোহন হালদার, আমিরা বিবি জানালেন, ‘আমার বাড়ি’ প্রকল্প অনুমোদন হওয়ার পরে ঠিকাদার এসে বলেছিল তারাই ঘর বানিয়ে দেবে। সেই সময় ওদের কথামতোই তাঁরা ঘর ভেঙে জায়গা দিয়েছিলেন। এর পরে নির্মাণ কাজ শুরুও হয়েছিল। কিন্তু ঘর তৈরি হওয়ার আগেই হঠাৎ কাজ বন্ধ হয়ে গেল। তার পর থেকে এর বাড়ি ওর বাড়িতে থাকছিলেন। শেষে বাধ্য হয়ে ফের নিজেরাই ওই জায়গায় মাটির দেওয়াল তুলে ত্রিপলের ছাউনি দিয়ে বাস করছেন। তাঁদের সমস্যার কথা একাধিক বার পঞ্চায়েত থেকে বিডিও সকলকে বলা হলেও কোনও কাজ হয়নি।
মথুরাপুর-২ পঞ্চায়েত সমিতির তদানীন্তন তৃণমূল সভাপতি কংসমোহন কয়ালের দাবি, “সেই সময় ‘আমার বাড়ি’ প্রকল্পে ঘর তৈরির ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসন এবং সিপিএম বিধায়ক মিলে ৮০০ জনের তালিকা তৈরি করেন। সেই সুযোগে স্বজনপোষণ করেছিল সিপিএম। দেখা গিয়েছিল বাড়িগুলির মধ্যে ৩০০ বাড়ি নিয়ম মেনে অনুমোদন পায়নি। তা ছাড়া বেনিফিশিয়ারি ঠিক করতে গেলে কমিটির মাধ্যমে করতে হয়। এ ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। সাধারণত বিডিও, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি, বিধায়ক মিলে কমিটি তৈরি হয়। সেই নিয়ম মানা হয়নি। এই সব কারণেউ আমরা বিরোধিতা করেছিলাম।”
যদিও বর্তমানে ওই পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সিপিএমের পীযূষকান্তি বারিকের দাবি, “সেই সময় আমরা রাজ্যে সরকারে থাকলেও পঞ্চায়েত সমিতিতে ক্ষমতায় ছিল তৃণমূল। ওরা মিথ্যা অভিযোগ এনে প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেয়। এর ফলে কয়েকশো ঘর সম্পূর্ণ হলেও বাকি ঘরগুলির কোনও তৈরিই হয়নি। আবার কোনওটি অর্ধসমাপ্ত অবস্থাতেই পড়ে রয়েছে। এর পরে রাজ্যে সরকার বদল হয়েছে। অথচ এই প্রকল্পে ঘর তৈরির জন্য এখনও প্রায় চার কোটি টাকা পড়ে রয়েছে। পঞ্চায়েত সমিতিতে আমরা ক্ষমতায় আসার পরে কাজ শুরু করার জন্য ব্লক প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনের কাছে দরবার করলেও কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি।” |