জনপ্রিয় পথ নয়, খুলে দিলেন সংস্কারের দরজা
লোকসভা ভোট দরজায় কড়া নাড়ছে। তা-ও পূর্বসূরিদের পথে হেঁটে জনমোহিনী বাজেট পেশ করলেন না রেলমন্ত্রী মল্লিকার্জুন খার্গে। বরং বললেন সংস্কারের কথাই।
দু’দফার ইউপিএ শাসনে মাত্র দেড় বছর আগে প্রথম বারের জন্য রেল মন্ত্রক হাতে পেয়েই যাত্রিভাড়া বাড়িয়েছিল কংগ্রেস। প্রায় এক দশক পরে ভাড়া বাড়ানোর সেই সাহস দেখানোর জন্য শিল্পমহলের সাধুবাদও কুড়িয়েছিল তারা। আর তার জেরে সামান্য হলেও হাল ফিরেছে রেলের কোষাগারের। এ বার বাজেটেও যাত্রিভাড়া বাড়ানো হোক এমনটাই চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর দফতর এবং যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া। ভোটের দিকে তাকিয়ে এক বছরে দু’বার ভাড়া বাড়ানোর দুঃসাহস খার্গে দেখাননি বটে, কিন্তু সেরে ফেলেছেন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সংস্কারের কাজটি।
সেটি হল, যাত্রিভাড়া ও পণ্যমাসুল নির্ধারণের জন্য স্বাধীন কর্তৃপক্ষ গঠন। টেলিকম বা বিদ্যুতের ক্ষেত্রে দাম নির্ধারণের দায়িত্ব এমনই স্বাধীন কর্তৃপক্ষকে দেওয়া রয়েছে। খার্গে বলেন, “রেল বোর্ডের পরিবর্তে ওই কর্তৃপক্ষই জ্বালানি খরচ বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে যাত্রিভাড়া ও পণ্য মাসুল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেবে।” শিল্পমহল বলছে, রেলমন্ত্রীর বাজেটে সংস্কারের পথে এটাই সব থেকে বড় পদক্ষেপ।
আয় বাড়াতে খার্গের দ্বিতীয় পদক্ষেপ, প্রিমিয়াম ট্রেন। চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে যে ট্রেনের টিকিটের দাম। ঠিক যেমনটি হয় বিমানের ক্ষেত্রে। রেলের দাবি, যে রুটে এই ট্রেন চলবে, সেই রুটে রাজধানী বা শতাব্দীর মতো ট্রেনগুলির তুলনায় প্রায় ৪৮% অর্থ বেশি ঘরে আনা যাবে।
বস্তুত, আয় বাড়ানোর উপায় নিয়েই পদে পদে ভাবতে হয়েছে খার্গেকে। বাজেট বক্তৃতায় তিনি স্পষ্টই বলেছেন, ভাঁড়ারের যা অবস্থা, তাতে পূর্বসূরিদের মতো জনমোহিনী পথে হাঁটবেন না তিনি। জানিয়েছেন, অর্থের অভাবে বহু ক্ষেত্রে নতুন লাইন নির্মাণ, ডাবলিং ও গেজ পরিবর্তনের কাজ থমকে গিয়েছে। চলতি বছরে রেল সার্বিক ভাবে আয়-ব্যয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছিল, তা-ও ছোঁয়া যায়নি। ছোঁয়া যায়নি অপারেটিং রেশিও-র (একশো টাকা আয় করতে রেলের যে টাকা খরচ হয়) লক্ষ্যমাত্রাও। আগের রেলমন্ত্রী পবন বনশল দাবি করেছিলেন, চলতি আর্থিক বছরে অপারেটিং রেশিও হবে ৮৭.৮%। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা এসে থেমেছে ৯০.৮%-এ। পরিস্থিতিটা অবশ্য আগের থেকে কিছুটা ভাল। ফলে সার্বিক ভাবে কেন্দ্রের কাছ থেকে পাওয়া বাজেট সাহায্য বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর কেন্দ্র যেখানে ২৮ হাজার কোটি টাকা সাহায্য করেছিল, এ বার তা বেড়ে হয়েছে ৩০ হাজার কোটি। কিন্তু অনেক পথ পেরনো বাকি।
আর সেই কারণেই লালু প্রসাদ বা নীতীশ কুমারের মতো ভোটের আগের রেল বাজেটকে আমজনতার মন পাওয়ার কাজে ব্যবহার করেননি খার্গে। পাঁচ বছর আগে ভোট অন অ্যাকাউন্ট পেশ করতে গিয়ে ৯০টির মতো নতুন ট্রেন ঘোষণা করেছিলেন লালু। সঙ্গে কিছু জনমোহিনী ঘোষণা। ২০০৪ সালে এনডিএ জমানাতেও নীতীশ অন্তর্বর্তী বাজেট পেশ করেন মূলত নিজের রাজ্য বিহারের বিধানসভা ভোটের দিকে তাকিয়েই।
সেই প্রথা ভেঙে আজ নতুন পথে হাঁটলেন খার্গে। নতুন ৭২টি ট্রেন চালানোর ঘোষণা ছাড়া তাঁর বাজেটে জনতার মন জেতার চেষ্টা বিশেষ নেই। এমনকী এই ঘোষণাও বেড়ে চলা যাত্রীদের চাপ সামাল দিতে প্রয়োজনীয় বলেই আখ্যা দিচ্ছেন রেল কর্তারা।
খার্গের এই বাজেটের অবশ্য কড়া সমালোচনা করেছে বিরোধীরা। বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদীর কথায়, “রেলের এত ভাল পরিকাঠামো সত্ত্বেও তার আধুনিকীকরণে নজর নেই সরকারের। যার প্রভাব রেলের স্বাস্থ্যে পড়েছে।”
আর খার্গের বাজেট নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে তৃণমূল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বক্তৃতার শুরুতে রেলমন্ত্রী জানান, এটা ২০১৪-’১৫ সালের বাজেট। এটা বিভ্রান্তিকর। এই ভোট অন অ্যাকাউন্টের উদ্দেশ্য হল একটাই সংসদের কাছ থেকে আগামী চার মাসের খরচ চালানোর অনুমতি নিয়ে রাখা।’ তাঁর বক্তব্য, ‘এটা সংবিধানের রীতিবিরুদ্ধে এবং অনৈতিকও।’ সিপিএমের অভিযোগ, সংস্কারের নামে সাধারণ মানুষের উপরে চাপ বাড়ানোর কৌশল নিয়েছে রেল।
রেল কর্তারা কিন্তু বলছেন, শৃঙ্খলা মেনে এই সংস্কারের পথে হাঁটলে তবেই রেলের আর্থিক স্বাস্থ্য ফেরানো সম্ভব। বছরের পর বছর জনতার মন রাখার মূল্য দিতে গিয়ে যা কার্যত তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। সেই সঙ্গে আর্থিক মন্দার ধাক্কায় আরও বেহাল হয়ে পড়েছিল রেলের কোষাগার।
আশার কথা এটাই যে সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার রাজনৈতিক সাহসের পাশাপাশি সার্বিক ভাবে দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে পণ্য পরিবহণের পরিমাণ থেকে। রেল মন্ত্রক জানিয়েছে, ওই খাতে চলতি বছরে আয় বেড়েছে পাঁচশো কোটির কাছাকাছি। তবে আগামী অর্থ বছরে লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ধীরে-সুস্থে পা ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রক। রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান অরুণেন্দ্র কুমারের বক্তব্য, “বাস্তবের সঙ্গে তাল মিলিয়েই লক্ষ্যমাত্রা সামান্য বৃদ্ধি করা হয়েছে।”
চলতি বছরে লক্ষ্যমাত্রা ছোঁয়ায় পণ্য পরিবহণে নতুন করে ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়নি মন্ত্রক। গত এক দশকে রেলের ভাড়া না বাড়ানোয় ক্ষতি সামলাতে ক্রমাগত বেড়েছে পণ্য পরিবহণের খরচ। ফলে রেলের মাধ্যমে পণ্য পরিবহণের খরচ বেড়ে যাওয়ায় গত তিন-চার বছর ধরে সড়ক পথে পণ্য পরিবহণ করার দিকেই ঝুঁকছিলেন ব্যবসায়ীরা। চলতি বাজেটে ওই খাতে ভাড়া না বাড়ায় এক দিকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে ব্যবসায়ী মহল, অন্য দিকে নতুন করে মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনাও খারিজ হয়ে গিয়েছে।
আয় বেড়েছে যাত্রিভাড়া ক্ষেত্রেও। ওই খাতে চলতি অর্থবর্ষে আয় বৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৮ শতাংশ। তা সত্ত্বেও গত এক দশকের মতোই ওই খাতে লাভের মুখ দেখতে ব্যর্থ রেল মন্ত্রক। কারণ, ইউপিএ সরকারের দু’পর্বে গোটা দেশে যাত্রিবাহী ট্রেন বেড়েছে প্রায় ৪ হাজার। ফলে পাল্লা দিয়েই বেড়েছে যাত্রী পরিবহণে ক্ষতিও। এ বছরেও যাত্রিভাড়া ক্ষেত্রে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪৭১০ কোটি টাকার কাছাকাছি। এর মধ্যে বাতানুকূল ক্ষেত্রে যাত্রিভাড়া লক্ষ্যমাত্রা ছুঁলেও, সাধারণ শ্রেণির ক্ষেত্রে প্রায় ছয় হাজার কোটি হারিয়েছে রেল। ফলে সব মিলিয়ে চলতি বছরে রেলের সার্বিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি।
খার্গের আট মাসের মন্ত্রিত্বে একাধিক ট্রেনে আগুন লাগার ঘটনা সামনে আসায় চলতি বাজেটে সুরক্ষা খাতেও বিশেষ ভাবে নজর দিয়েছে রেল। বিশেষ করে চলন্ত ট্রেনে অগ্নিকাণ্ড রুখতে কামরার সাজসজ্জা অগ্নি নিরোধক বস্তু দিয়ে নির্মাণ করা, ইলেকট্রনিক সার্কিট ও ওয়্যারিং-র নিয়মিত পরীক্ষা করা, প্রতিটি কামরায় আগুন নেভানোর যন্ত্র রাখারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ট্রেনের প্যান্ট্রিগুলিতে সিলিন্ডারের পরিবর্তে ‘ইনডাকশন কুকার’ ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছেন খার্গে।
টানাটানির সংসারে রেলমন্ত্রী মল্লিকার্জুন খার্গে আরও একটা কাজ করেছেন। বড় মাপের ঘোষণায় না গিয়ে জোর দিয়েছেন যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য এবং সুরক্ষায়।

কেন্দ্রীয় সরকার যেখানে ১০০ দিনের কাজের টাকা দেওয়াই বন্ধ করে দিয়েছে, সেখানে আবার নতুন নতুন ঘোষণা হচ্ছে। নতুন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে। এগুলো লোক ঠকানোর কৌশল নয় কি?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.