আসবাব থেকে ইলেকট্রনিক্স, খেলনা থেকে রঙিন আলো, মায় ভারতীয় বিয়ের কার্ড-তত্ত্বেও থাবা বসিয়েছে চিন। দেশের বাজার ছেয়ে গিয়েছে চিনে তৈরি বিবিধ পণ্যে। এ বার আকাশেও শুরু হয়েছে চিনা আগ্রাসন। যার জেরে প্রমাদ গুনছে ভারত।
বিমান মন্ত্রক সূত্রের খবর, চিনের ডাকে বিদেশি বিভিন্ন বিমানসংস্থার উড়ান ভারতীয় আকাশ ছেড়ে সে দেশের আকাশ ব্যবহার করতে শুরু করেছে। এতে বিদেশি উড়ানকে এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল (এটিসি)-পরিষেবা জোগানো বাবদ ভারতের যা আয় হতো, তাতে কোপ পড়েছে। এ ক্ষেত্রে দৈনিক গড়ে ৩৫ লক্ষ টাকা হাতছাড়া হচ্ছে বলে সরকারি সূত্রের খবর। চিনা হাতছানিতে সাড়া দিয়েছে মূলত জাপান-তাইপেই-দক্ষিণ কোরিয়া বা হংকং থেকে ইউরোপ-পশ্চিম এশিয়ায় যাতায়াত করা বিমানগুলো।
মন্ত্রকের হিসেবে, ভারতের উপর দিয়ে চলাচলকারী মোট বিদেশি বিমানের প্রায় ২০% গত ক’মাসে ভারতের আকাশ ছেড়ে চিনা রুট ধরেছে। কেন?
বলা হচ্ছে, চিনা রুটে বিশেষত জাপান-হংকঙের মতো উত্তর-পূর্ব এশিয়া থেকে ইউরোপগামী বিমানের যাত্রাপথ কমছে অনেকটাই। ফলে জ্বালানি খরচে সাশ্রয় হচ্ছে। স্বভাবতই তারা সুবিধাটি নিতে দু’বার ভাবছে না। উপরন্তু যাদের যাত্রাপথ সে ভাবে কমছে না, তারাও চিনের দিকে ঝুঁকছে। যার কারণ হিসেবে চিনা কর্তৃপক্ষের ‘আগ্রাসী’ মনোভাবের ছায়া দেখছেন অনেকে। নয়াদিল্লির বিমান মন্ত্রকের একাংশের ব্যাখ্যা: বিদেশি বিমানকে উড়তে দেওয়ার বিনিময়ে যে মোটা রোজগার করা যায়, বেজিং সম্প্রতি তা টের পেয়েছে। তাই ভিনদেশি বিমানের সামনে খুলে দিয়েছে এত দিন বন্ধ করে রাখা আকাশপথ। মন্ত্রকের কিছু মহলের এ-ও ধারণা, আকাশ ব্যবহারের মূল্যের ক্ষেত্রেও সম্ভবত বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে নতুন রুট। তা ছাড়া আগের রুটে ভারত ছাড়াও তাইল্যান্ড-মায়ানমার-বাংলাদেশের আকাশ ব্যবহারের জন্য ওই সব দেশকে টাকা দিতে হচ্ছিল। চিনা রুটে সে দায়ও থাকছে না।
ভারতীয় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছেন, এ দেশের আকাশ ব্যবহারকারী প্রতিটি বিমানপিছু ভারত সরকার প্রায় ৩৫ হাজার টাকা পায়। যেমন কলকাতার উপর দিয়ে রোজ এ রকম শ’পাঁচেক বিদেশি বিমান উড়ে যায়। এরা ভারতের কোনও বিমানবন্দরে ওঠে-নামে না, শুধু যাওয়ার পথে কলকাতা এটিসি-র সহায়তা নেয়। তাদের পথ দেখিয়ে ভারতের সীমান্ত পার করে দেয় এটিসি। |
আর এই পরিষেবারই দাম চোকায় সংশ্লিষ্ট বিমানসংস্থারা। সরকারের আয় বাড়ে। চিনা রুটের রমরমা যাতে থাবা বসিয়েছে। কলকাতা বিমানবন্দরের তথ্য বলছে, ক’মাস আগেও ভারত দিয়ে যত বিদেশি উড়ান চলত, তার এক-চতুর্থাংশ ছিল হংকঙের ক্যাথে-প্যাসিফিক সংস্থার। ক’মিনিট অন্তর অন্তর ক্যাথে’র বিমান ভারতে ঢুকে কলকাতা এটিসি-র সঙ্গে যোগাযোগ করত। কিন্তু ইদানীং তারা ভারতকে কার্যত বর্জন করেছে। ক্যাথে-র মুখপাত্রের কথায়, “ভারতের বদলে চিনের আকাশ দিয়ে ওড়ায় আমাদের জ্বালানি বাঁচছে।”
তা হলে এত দিন তারা চিনের উপর দিয়ে ওড়েনি কেন?
বিমান মন্ত্রক সূত্রের ব্যাখ্যা, চিন এত দিন বিদেশি বিমানকে এ ভাবে নিজের আকাশ ব্যবহার করতে দিত না। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা যদি তার একটা কারণ হয়ে থাকে, তা হলে অন্যটা ছিল উপযুক্ত প্রযুক্তির অভাব। উড়ান-পথে সঠিক দিগ্নির্দেশ পেতে হলে এটিসি-সহযোগিতার পাশাপাশি মাটিতেও ২০০ নটিক্যাল মাইল (৩৭০ কিলোমিটার) অন্তর এক ধরনের যন্ত্র থাকা দরকার। দক্ষিণ চিনের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় দূরত্ব মেপে সে ভাবে যন্ত্র বসানো সম্ভব হয়নি।
তবে পাইলটেরা ইদানীং স্যাটেলাইটের সহায়তা পেতে থাকায় সমস্যাটি আর নেই। “চিন এর পুরো ফায়দা তুলছে। পাশাপাশি ওরা দেখেছে, বিদেশি বিমানকে রুট খুলে দিলে উপার্জনেরও বিস্তর সম্ভাবনা। তাই চিন এখন দরাজ হয়ে নিজের আকাশ যতটা সম্ভব খুলে দিয়েছে। ভারতের আকাশ থেকে টেনে নিচ্ছে নানা বিমানকে।” বলেছেন কলকাতা বিমানবন্দরের এক কর্তা।
পরিণামে রোজগার ফস্কাচ্ছে ভারত। দিনে প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা। কিছুই কি করার নেই?
বস্তুত সরকারের কণ্ঠে খানিকটা অসহায়তারই সুর। তাদের যুক্তি, কোন দেশের উপর দিয়ে কোন উড়ান উড়বে, সেটা একান্তই সংশ্লিষ্ট বিমানসংস্থার সিদ্ধান্ত। তবে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি, ক্যাথের মতো সব ক্ষেত্রে চিনা রুটে জ্বালানি সাশ্রয়ের সম্ভাবনা নেই। এবং সেটাই একটা ভরসার কথা। কেন?
কর্তৃপক্ষের যুক্তি, অস্ট্রেলিয়া-সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া-তাইল্যান্ড-ইন্দোনেশিয়া বা ফিলিপিন্সের মতো দেশের কিছু বিমানকে ভারতের পরিবর্তে চিন দিয়ে ঘুরে যেতে হলে জ্বালানি বেশি লাগবে। তাই ওদের অন্তত ভারতের আকাশ ব্যবহার করতেই হবে। |