ভুল স্বীকার করে বিদ্ধ বুদ্ধদেব,
সিপিএম কি বদলাবে না
মি পন্ডিত-অধ্যাপক নই। আমি সাংবাদিক।
তাই আমার লেখায় ফুটনোট এবং গ্রন্থঋণের তালিকার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল দীর্ঘ ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা আর আগ্রহ।
আমাদের দেশে পন্ডিত-অধ্যাপকদের রচনা সম্পর্কে জনপ্রিয় নালিশ হল, সেগুলি ব্রহ্মতালুতে সুপারি রেখে খড়মপেটা করে। সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছয় না। আর সাংবাদিকদের রচনা সম্পর্কে অভিযোগ থাকে, সেখানে গভীরতার অভাব বড়ই প্রকট। সাংবাদিকেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দৈনন্দিন কড়চার ঊর্ধ্বে বৃহৎ প্রেক্ষাপটকে স্পর্শ করতে পারেন না।
এই দুই চরম অবস্থার মাঝামাঝি একটি পরিসর খুঁজে বের করতে হবে। যেখানে সাংবাদিকের রচনা মানেই অগভীরতা নয়। আবার পান্ডিত্য প্রদর্শনের সহজিয়া প্রবণতাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
সম্প্রতি ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে সিপিএমের জনসমাবেশ হল। অনেক দিন পর ব্রিগেডের সমাবেশ দলকে সাংগঠনিক ভাবে উজ্জীবিত করেছে। এই ব্রিগেড সমাবেশের পর কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, এত মানুষ এত কিছুর পরেও যখন আসছেন, তা হলে আড়াই বছরের শাসকদের বিরুদ্ধেও অসন্তোষ এবং জনমত তৈরি হচ্ছে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, মানুষ এলে কী হবে, নেতারা তো ঐক্যবদ্ধ নন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দেশ এবং সমাজের কথা ভাবছেন। কিন্তু দলীয় নেতারা এখনও কমরেড তন্ত্রের বাইরে বেরোতে চাইছেন না। এই ভিড় কোনও ভাবে নির্বাচনী ফলাফলে প্রভাব বিস্তার করবে কি না, অনেকে সেই প্রশ্নও তুলেছেন।

রবিবাসরীয় ব্রিগেডে বাম সমাবেশ। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
আমার কাছে এই সব প্রশ্নই আপাত এবং ক্ষুদ্র প্রশ্ন। বৃহৎ প্রশ্নটি হল, কোন পথে এগোবে সিপিএম? কোন বামপন্থার অভিমুখে তাঁরা নিয়ে যেতে চাইছেন দলকে? কোন মতাদর্শকে এখন মডেল করা হবে? তৃতীয় ফ্রন্ট গঠন হবে কি হবে না? কেন্দ্রে প্রকাশ কারাট কিংবা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন কি না— এ সব প্রশ্নই এখন অবান্তর। এর আগে একটি নির্বাচনে নতুন বামফ্রন্ট গড়ার ডাক দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল উন্নততর বামফ্রন্ট। সেই নতুন সিপিএমের বামপন্থাটা কতটা সাবেক, কতটা নতুন?
এ দেশের সংসদীয় ব্যবস্থায় বামপন্থী দলগুলির মধ্যে সিপিএম-ই সব চেয়ে বড় দল। বয়সে প্রবীণতর হলেও সিপিআইয়ের সংসদীয় এবং সাংগঠনিক ক্ষমতা সিপিএমের থেকে কম। ফরওয়ার্ড ব্লক অথবা আরএসপি-র আরও কম। সিপিএমের সব থেকে বড় সাংগঠনিক শক্তির জায়গাটি কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ। ’৭৭ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর প্রায় ৩৫ বছর ধরে সিপিএম-ই ছিল প্রধান শাসক দল। গত বিধানসভা নির্বাচনে এই দীর্ঘ বাম শাসনের অবসানের ফলে স্বভাবতই শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, গোটা দেশেরই বাম রাজনীতিতে একটি বিপর্যয় দেখা গিয়েছে। আর এই বিপর্যয়ের জন্যই কিন্তু এখন সিপিএম কোন পথে এগোবে বা ভারতীয় কমিউনিস্টরা কোন পথে এগোবেন, সেটি এত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।
ব্রিগেডে একটা কেন, একশোটা সমাবেশ করুক সিপিএম। কিন্তু দলের মধ্যে আগামী দিনের চলার পথ নিয়ে সত্যি সত্যি কি কোনও চিন্তাভাবনার মন্থন হবে? না কি যে ভাবে যে পথে তারা এত দিন চলেছে, সে পথেই তারা চলতে চাইছে? দলেরই এই ব্যর্থতার মূল্যায়ন করতে গিয়ে মতাদর্শগত ভিত্তি নিয়ে সত্যি সত্যিই কি কোনও খোলামেলা বিতর্ক হওয়া উচিত নয়? এ কথা ঠিক, পুঁজিবাদের নানা রকমের সঙ্কট চোখে পড়ছে আমাদের। পৃথিবীর বহু প্রান্তে সমাজতন্ত্রের প্রাসঙ্গিকতা অনুভূত হচ্ছে। এরিক হবসবামের মতো মাকর্সবাদী তাত্ত্বিকও বলছেন, পুঁজিবাদী তাত্ত্বিকেরাই সমাজতন্ত্রীদের চেয়েও বেশি বেশি করে সমাজতন্ত্রের উপাদানকে ব্যবহার করছেন পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য।
লাতিন আমেরিকা, গ্রিস, এমনকী রাশিয়াতেও আবার কমিউনিস্টরা আগের তুলনায় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন। ‘ওকুপাই ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্ট’ দেখে এ দেশেরও বহু কমিউনিস্ট উৎসাহিত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু মূল প্রশ্নটা অন্য। পৃথিবীর অন্য প্রান্তে মাকর্সবাদের যে ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে, ক্যারিবিয়ান সমুদ্র তীরে যে মাকর্সবাদকে আমরা দেখছি, তারও আঙ্গিক কিন্তু অন্য রকম। কিন্তু এ দেশে প্রকাশ কারাট অথবা এ বি বর্ধন নিজেদের সময়োপযোগী করতে কতটা উৎসাহী, সে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
ব্রিগেড-মঞ্চে বাম নেতৃত্ব। —নিজস্ব চিত্র।
কলেজ জীবনের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। তখন রাজনীতি বিজ্ঞানের ছাত্র। সে সময় কলকাতা শহরের বহু ছাত্রছাত্রীর মতো মাকর্সবাদের প্রতি আকৃষ্ট। রাজ্যে শাসক দল সিপিএম। সে সময় আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনা প্রবেশের ঘটনা আমাদের নরম মাকর্সবাদী সত্তায় তীব্র আঘাত হেনেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নকশাল ছাত্র সংগঠন জোরদার প্রচার অভিযান শুরু করে দিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের নয়া উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে। ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ’ নামক একটি শব্দ তখন খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এমন একটা সময়ে, ১৯৮২-’৮৩ সালে আমরা কয়েক জন ছাত্র মিলে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলাম। যার নাম ছিল ‘অন্য চোখে’।
বক্তব্য ছিল, মাকর্সবাদের সমস্ত ধারা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা শুরু হোক। মাকর্স, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন এবং মাও ছাড়াও কেন গ্রামসি এবং ট্রটস্কি নিয়ে আমরা আলোচনা করব না? কেন প্লেখানভ বা বুখারিনকে আমরা জানব না? কিন্তু তখন সিপিএম এত বেশি লেনিন এবং স্তালিনপন্থী ছিল যে খোলা মনে ট্রটস্কি এবং গ্রামসিকে নিয়ে লেখাজোখা দেখে অসন্তুষ্ট হয়েছিল। সিপিএমের এক অধ্যাপক নেতা ডেকে বলেছিলেন, এত বহুত্ববাদী হলে অভিমুখ ঠিক করা যায় না।
এই যে প্রাতিষ্ঠানিক মতাদর্শগত ডু’স অ্যান্ড ডোন্ট’স— এটা বড় ভয়ঙ্কর। দেশে-বিদেশে নানা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও এই অনুশাসন রয়েছে। কিন্তু এখন মনে হয়, এই হেজেমনি মুক্তচিন্তার বিরোধী। আজ এত বছর পরেও সিপিএম নেতারা এই অনুশাসনের বাইরে যেতে পারছেন না।
কিছু দিন আগে ‘ক্যারাভান’ পত্রিকায় প্রকাশ কারাটের সঙ্গে রামচন্দ্র গুহর বিতর্ক হয়। রাম গুহ বলে চলেছেন, কারাট এক জন স্তালিনীয় চিন্তাবিদ। আর কারাট বলে চলেছেন, রাম গুহ লিবারাল ডেমোক্র্যাট। এই যে প্রথমেই একটি বিশেষণে চিহ্নিতকরণ, তাতে খোলা মনে আলোচনার অবকাশ কোথায় থাকে? কলেজ জীবনে এটি ছিল নিছক ছাত্র জিজ্ঞাসা। ক’দিন আগে শোভনলাল দত্তগুপ্তের ‘সমাজ মাকর্সতত্ত্ব ও সমকাল’ শীর্ষক বইতে পড়লাম, লেখক প্রশ্ন তুলেছেন যে আধুনিক বামপন্থা এবং মাকর্সবাদ একমাত্রিক নয়। এই বিভিন্ন মাত্রা নিয়ে আলাপ-আলোচনা আজ অনেক বেশি প্রয়োজন। প্রয়োজন গ্রামসি, ট্রটস্কি থেকে শুরু করে অতীতের নানা সমাজতন্ত্রীর মতামত বা মডেল পরীক্ষা করে দেখা।
দুর্গম যাত্রা। ব্রিগেডমুখী লাল পতাকা। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।
চিন্তাবিদ হিসেবে এক জন ‘বেসরকারি’ মাকর্সবাদী এমনটা ভাবতে পারেন, তা হলে সিপিএম সেটা কেন ভাববে না? কোন সুদূরে বসে মাকর্সবাদী তাত্ত্বিক জিজেক যে নানা রকম নতুন নতুন ভাবনাচিন্তার কথা বলছেন, সেগুলি নিয়ে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট কেন আলোড়িত হবে না? হবসবাম বলেছিলেন, মাকর্স শুরু করেছিলেন, শেষ করেননি। শেষ করার দায়িত্ব তো পরবর্তী প্রজন্মের। যে হবসবামকে গুরুর মর্যাদা দিতেন কারাট, তিনিই লিখেছেন, কেন গ্রামসি আমাদের পড়া প্রয়োজন। ভারতের সমাজতন্ত্র কমিন টার্নের সংস্কৃতি থেকে বের করে ভারতীয় বামপন্থায় স্বাধীনতার এত বছর পরেও কেন সিপিএম সফল হতে পারল না? অথচ সাম্প্রদায়িক শক্তি বলে গালিগালাজ করলেও সেই ১৯২৫ সালে তৈরি হওয়া আরএসএস গোটা দেশে কমিউনিস্টদের থেকে বেশি ভারতীয়ত্বের দাবি রাখে।
ক্রুশ্চেভ তাঁর বিরুদ্ধে ব্যক্তিপূজার অভিযোগ তোলার পরে রাশিয়ার রাস্তা, সরকারি দফতর থেকে রাতারাতি মুছে ফেলা হয় স্তালিনের নাম ও ছবি। স্তালিনগ্রাদ শহরের নামটাও ছেঁটে ফেলা হয়। কিন্তু আবার সেই স্তালিনগ্রাদ ফিরে এসেছে। নাৎসিদের পরাজয়ের সত্তরতম বার্ষিকীতে সেই নাম ফিরে পেয়েছেন রাশিয়ার মানুষ। পুতিন শক্তিশালী রাশিয়া গড়ার জন্য স্তালিনের ছবি ফিরিয়ে আনার কথা বলছেন। সম্প্রতি গ্রোভার ফার ‘ক্রুশ্চেভ মিথ্যা বলেছিলেন’ শীর্ষক একটি গ্রন্থে দেখিয়েছেন, স্তালিন সম্পর্কে ক্রুশ্চেভ অনেক কথাই মিথ্যা বলেছিলেন, যার ভিত্তিতে স্তালিন-বিরোধী অভিযান শুরু হয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির বিংশ পার্টি কংগ্রেসে (১৯৫৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি) নিকিতা ক্রুশ্চেভের গোপন বক্তৃতা প্রকাশ করে সম্প্রতি গবেষণালব্ধ একটি বইতে এই গ্রোভার ফার প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, স্তালিন আদৌ এমন স্মৈরতান্ত্রিক ব্যক্তি ছিলেন না।
ভারতের, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের যে কোনও বামপন্থী ভাবুক কিন্তু সব থেকে আগে চলার অভিমুখটি সম্পর্কে জানতে চায়। চার দিকে যেখানে এত স্ববিরোধ, এত ঝড়ঝাপটা, সেখানে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতো নেতা ভুল স্বীকার করলে দলের কাছে কথা শুনতে হয়। সেখানেই সংশয় জাগে, ব্রিগেডে কত মানুষ হল, সেই পেশীশক্তির পরিচয় জরুরি না কি পরবর্তী প্রজন্মকে ঠিক পথের সন্ধান করে দেওয়াটা অনেক বেশি জরুরি?

পুরনো সমাচার:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.