প্রান্তিক সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করলে শিকড়ে টান পড়ে

রুণাচল প্রদেশ থেকে রাজধানী দিল্লিতে পড়তে আসা প্রথম বর্ষের এক কলেজ ছাত্রকে যে ভাবে লাজপত নগরে পিটিয়ে মারা হয়েছে তা দেখে এই ধারণা আরও এক বার স্পষ্ট হয়ে গেল যে, আজও উত্তর-পূর্ব ভারতের জনগোষ্ঠীর প্রতি তথাকথিত ‘মূলস্রোত’-এর ভারতীয় মানসিকতা বড় তীব্র ভাবেই বিরূপ। ভারতীয় জাতীয়তার চেতনায় উত্তর-পূর্বের মঙ্গোলয়েড জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক আত্তিকরণ হয়নি। প্রান্তিক আঞ্চলিক সত্তাকে তথাকথিত জাতীয়তা উদার মনে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। আঞ্চলিকতার নানা দিক। এই আঞ্চলিকতাকে যদি সুষ্ঠু ভাবে আমরা গ্রহণ করতে না পারি তা হলে জাতীয়তাবাদও কোনও বিমূর্ত অশরীরী আত্মা হতে পারে না।
নিদো টানিয়াম
আসলে বহু যুগ, বহু বছর ধরে প্রান্তিক নিম্নবর্গের মানুষের ইতিহাসকে অবজ্ঞা করে তার উপর স্টিম রোলার চালিয়ে এক শক্তিশালী ভারত গঠনের কথা আমরা বলে চলেছি। তাতে কিন্তু কেন্দ্রও দুর্বল হয়ে পড়ে। অঞ্চল ও কেন্দ্রের সমন্বয়ের বদলে সংঘাত বড় হয়ে ওঠে। অষ্টাদশ শতকে মোগল সাম্রাজ্যের সঙ্কট বুঝতে আধুনিক ইতিহাস-চিন্তা বলে, ঔরঙ্গজবের সময়ে সাম্রাজ্যের পতন শুরু হলেও তার পিছনেও ছিল বিভিন্ন প্রান্ত বা অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতা। নানা উপ-সংস্কৃতি, নানা জাতি-উপজাতি, ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিচ্ছিন্নতা। যেমন, ১৬৮০-’৮৫ সালে গুজরাতের মাতিয়া নামক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ শুরু হয়। এর পিছনে প্রতিবাদী ধর্মের প্রভাব কাজ করলেও এর কারণ কিন্তু ছিল আর্থ-সামাজিক। গুজরাতের কোলি কৃষক সম্প্রদায় থেকে বর্তমান অমেঠী এলাকায় ১৬৭০-’৮০ সালে কুর্মি কৃষক বিদ্রোহ হয়। মথুরায় আঞ্চলিক জমিদার বা জাঠেদের বিদ্রোহ হয়। খটক নামে এক আফগান উপজাতির বিদ্রোহও উল্লেখযোগ্য। আজ এত বছর পর আধুনিক ইতিহাস চিন্তা বলছে, সে দিনও কেন্দ্রীয় শাসক সম্রাট ও তাঁর আমির-ওমরাহদের বিরুদ্ধে প্রান্তিক-আঞ্চলিক মানুষের বিদ্রোহই ধীরে ধীরে অষ্টাদশ শতকে মোগল সঙ্কট ডেকে আনে।
আজও সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। ‘একক মাত্রা’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিনে ‘আঞ্চলিকতার বহুরূপ’ শীর্ষক প্রচ্ছদ নিবন্ধে যথার্থ ভাবেই বলা হয়েছে, ভৌগোলিক অর্থে ‘আঞ্চলিকতা’ বোঝার নীতিকে অতিক্রম করেছে এ সময়। আঞ্চলিকতার খণ্ডিত সত্তা নিয়ে আজ এ এক রামধনু সমাজ।

নিদো স্মরণে। দিল্লির রাজপথে প্রতিবাদ উত্তর-পূর্বের ছাত্রছাত্রীদের। ছবি: এএফপি।
আসলে পুঁজিবাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য হল গোটা পৃথিবীকে একই ধরনের একটা উন্নয়নমুখী মডেল বা ব্যবস্থায় পরিণত করা। বিশ্বায়নের স্টিম রোলার দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত সত্তাকে বিলীন করে মানবসমাজকে এক বিশ্বজনীন ‘অ্যাসর্টেড চকোলেট’-এ পরিণত করা। আঞ্চলিকতা একটি স্বাভাবিক সামাজিক ঘটনা। সেই নিজস্বতাকে অবলুপ্ত করে এক সাধারণ সংস্কৃতি ও অর্থনীতি গড়ে তোলাই পুঁজিবাদী লক্ষ্য। ১৯৩৯ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারল্ড ট্র্যুমান সেনেট বক্তৃতায় বলেন, “পৃথিবীর অধিক অবশ্যই অনুন্নত, আমাদের সামনে রয়েছে তাকে উন্নত করে তোলার অনন্ত দায়িত্ব ও সম্ভাবনা। কেবলমাত্র উৎপাদন বৃদ্ধিই উন্নয়নের উপায়।”
তাই সব সার্বভৌম রাষ্ট্রকে নিয়েই এক উন্মুক্ত বাজার গড়া পুঁজিবাদের মতাদর্শগত কর্মসূচি। পুঁজিবাদের মতাদর্শ উচিত না অনুচিত— সে বিতর্ক চলছে চলবে। কিন্তু এটা নিয়ে কোনও বিতর্ক নেই যে, ভারতের নানা প্রদেশে, নানা প্রান্তে আঞ্চলিকতার ভাবনার বৈচিত্রকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে।
এই দেখুন না, পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেও উত্তরবঙ্গ নামক এলাকাটি দীর্ঘ ৩৪ বছরের বামশাসনেও মর্যাদা পায়নি। রাজ্যের জনসংখ্যার বিচারে উত্তরবঙ্গে বাস করেন ২০ শতাংশেরও বেশি মানুষ। অথচ এই খণ্ডের ভাগ্যে জোটে রাজ্যের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্র তিন শতাংশ। এটা একটা ছোট্ট উদাহরণ। স্বাধীনতার পর নেহরুর ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠনও উচিত কাজ হয়েছে কি না, তা নিয়েও বিতর্ক আছে। রাজীব গাঁধী পর্যন্ত এক বার প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় বলে ফেলেছিলেন, এই ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য ভাগ করাটাই ঠিক হয়নি।
ভারতের মতো বহুত্ববাদী দেশে নানা ‘সাব কালচার’ আছে। আইএমআরবি ইন্টারন্যাশনাল-এর এক বিশেষজ্ঞ ইউনিট গ্রামীণ ভারতের এই উপ-সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা চালায়। বলা হচ্ছে, উপসংস্কৃতি কাকে বলব? উত্তর: মূল স্রোতের সংস্কৃতিকে কোনও গোষ্ঠীর পরিত্যাগ করা। মোবাইল থেকে প্যাকেট-বন্দি খাবার, এ সবই শহর থেকে গ্রামে ঢুকে উপসংস্কৃতির উপর মূল সংস্কৃতির আধিপত্য কায়েম করছে। কিন্তু এই প্রচেষ্টা এক দিকে যেমন কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে উপসংস্কৃতিকে যুক্ত করছে, অন্য দিকে তা গ্রামীণ অর্থনীতির স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থাকেও সমস্যায় ফেলেছে। সমন্বয়ের বদলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠছে।
আর ঠিক এই পরিস্থিতিতে ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটের মুখে জোট-যুগকে বুঝতে হলে আঞ্চলিকতার এই রূপকে বুঝতে হবে। এক সময় কেন্দ্রীভূত সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল বিশেষত কংগ্রেসের দাপট ছিল। আজ কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্ন। কংগ্রেস এবং বিজেপি-র বদলে আজ নানা প্রান্তে নানা আঞ্চলিক দল। প্রত্যন্ত আঞ্চলিক সত্তাগুলির ঝড় এসে আছড়ে পড়ছে শাহি দিল্লির দরবারে। একে বলা যায়, জাতীয় রাজনীতির আঞ্চলিকীকরণ। কিন্তু এই আঞ্চলিকতাবাদের চাপ কি কেন্দ্রের ‘হেজেমনি’কে ভেঙে দিতে সক্ষম হবে?
জোট-যুগ থেকে আপাতত মুক্তি নেই। কিন্তু তাতে কি প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর মর্যাদা পাবে?

পুরনো সমাচার:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.