|
|
|
|
|
পছন্দের সমীক্ষা না হলেই প্রাপ্য বিষোদ্গার
স্বাধীন নাগরিক সমাজে কোনও বেসরকারি সংস্থা যদি এই ধরনের
নির্বাচনী
সমীক্ষা করে, তা হলে তাদের উপরে রাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে না। লিখছেন
জয়ন্ত ঘোষাল |
|
ভারতের ষোড়শ লোকসভা নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। বিভিন্ন বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমে প্রাক-নির্বাচনী সমীক্ষা আসতে শুরু করেছে। মোটামুটি ভাবে প্রায় সব সংস্থাই কংগ্রেসের ভরাডুবির ভবিষ্যৎবাণী করছে। বলছে, ৫৪৩টি আসনের মধ্যে কংগ্রেসের আসন সংখ্যা একশোর নীচে চলে যাবে। দুশো অতিক্রম করবে এনডিএ।
ত্রিশ বছর সাংবাদিকতা করার পর আজকাল এই প্রাক-নির্বাচনী সমীক্ষাগুলির ঔচিত্য নিয়ে মনের মধ্যে কিছু প্রশ্ন জাগে। একটি জিনিস লক্ষ করেছি যে, ভারতের প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলই কম-বেশি রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার অভাবে ভোগে। অসমে তরুণ গগৈ-এর নেতৃত্বে কংগ্রেস আবার সরকার গড়বে, নির্বাচনী সমীক্ষা যখন এ কথা বলেছিল, তখন বিজেপি-র বহু নেতা খুব চটে গিয়েছিলেন। এই সমীক্ষাগুলি ভোটারদের প্রভাবিত করার জন্য একটি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে বলে তাঁরা অভিযোগ করেছিলেন। আবার এখন কংগ্রেস খারাপ করবে শুনে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা বলতে শুরু করেছেন, এ সব সমীক্ষার রিপোর্টের বিশ্বাসযোগ্যতা তাঁরা স্বীকার করছেন না। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল আম আদমি পার্টির নেতারা বলছেন, দিল্লির নির্বাচনী সমীক্ষায় তো কেউই বলেনি, তাঁরা ২৮টি আসন পাবেন। আজ এই সমীক্ষা যখন বলছে, কেজরিওয়াল দিল্লির বাইরে কিছু করতে পারবেন না, তখন সেটি মানব কেন? নির্বাচন কমিশনের কাছে কিছু দিন আগে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা গিয়েও এই নির্বাচনী সমীক্ষা বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। |
|
এ বার এই বিতর্কিত বিষয়ে আমার মতামত জানানোর চেষ্টা করছি। প্রথমত, কোনও স্বাধীন নাগরিক সমাজে কোনও বেসরকারি সংস্থা যদি এই ধরনের নির্বাচনী সমীক্ষা করে, তা হলে তাদের উপরে রাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারে না। কোনও রাজনৈতিক দল অর্থের বিনিময়ে নির্বাচনী সমীক্ষা রিপোর্ট তৈরি করছে, এই অভিযোগ যদি তোলা হয়, তা হলে তো সব দলেরই সেটা করার সুযোগ থাকে। প্রমাণহীন অভিযোগের ভিত্তিতে কোনও বেসরকারি সংস্থার স্বাধীনতায় রাষ্ট্র নাক গলাতে পারে না।
দ্বিতীয়ত, বেসরকারি সংবাদমাধ্যমের এ ধরনের সমীক্ষা করার ব্যবসায়িক তাগিদ অনস্বীকার্য। তার কারণ, অর্থনীতির চাহিদা এবং যোগানের তত্ত্ব। ভোট যত এগিয়ে আসছে, ততই মানুষের কৌতূহল বাড়ছে। বিভিন্ন বৈদ্যুতিন চ্যানেল ও সংবাদ মাধ্যমের সাহায্যে নির্বাচনী রাজনীতিটাও একটি বিনোদনে পরিণত হয়েছে। বাড়ি ফিরে বহু মানুষ সিরিয়াল না দেখে অর্ণব গোস্বামী অথবা সুমন দে-র অনুষ্ঠান দেখতে ভালবাসেন। তার পর সেই অনুষ্ঠান নিয়ে ঘরোয়া আড্ডায় অনেক বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু এই ধরনের রাজনৈতিক আলোচনার যে একটা খুব বড় খিদে আমজনতার মধ্যে আছে, সেটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। অতএব, সংবাদপত্রের বিক্রি এবং টিভি চ্যানেলের টিআরপি-র জন্য আগামী নির্বাচনের আগে প্রত্যেক মাসে এই সংস্থাগুলির একটি করে নির্বাচনী সমীক্ষা করাটা কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপারই নয়।
মানুষের মনস্তত্ত্বের মধ্যেও একটি যে কোনও বৃহৎ প্রেক্ষাপটে যে কোনও একটি বিষয়ে ক্যাটাগরি বা একটি শ্রেণি বিভাজনের প্রবণতা মানুষের মধ্যে থাকে। যে কারণে দেখবেন, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রায়শই প্রচ্ছদ নিবন্ধ হয়, ভারতের সেরা কলেজ, সেরা গায়ক-গায়িকার প্রতিযোগিতা, সেরা বাঙালি। এই ধরনের শ্রেণি ও গোত্রে বিভাজন নানা ধরনের সমীক্ষায় কিন্তু একটি উপভোক্তা আছে। ভোটের আগে এই সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং অর্থনৈতিক দিকটিকে কোনও বৃহৎ সংবাদ মাধ্যম উপেক্ষা করতে পারে না। এখনও অনেক লিটল ম্যাগাজিন বাণিজ্যিক প্রতিযোগিতাকে রেয়াত করে না। কিন্তু বৃহৎ সংবাদগোষ্ঠীর পক্ষে কি তা সম্ভব? তাকে তো আপস করতেই হবে বাজার অর্থনীতির সঙ্গে। |
|
সব থেকে বড় কথা, নির্বাচনী সমীক্ষা করাটা নীতিগত ভাবে বিরোধিতা করছি না। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় যে, আমাদের দেশে সব সংস্থাই কিন্তু খুব যত্ন করে, খুব পেশাদারি পরিশ্রম দিয়ে সমীক্ষা করে না। রাজনৈতিক দলগুলি যাদেরকে দিয়ে সমীক্ষা করায়, তারা তাদের প্রভুদের খুশি করতে চায়। যেমন গোয়েন্দা কর্তারা রাজনৈতিক প্রশাসকদের খুশি করতে চান তাঁদের রিপোর্টে। ফলে নির্বাচনী সমীক্ষার মতামত মূল্যবোধ-নিরপেক্ষ হওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে।
ডেভিড ইস্তন এক জন মার্কিন সমাজতত্ত্ববিদ। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ভ্যালু বা মূল্যবোধ আমার পরনের কোটের মতো নয় যে আমি গবেষণাগারে ঢোকার আগে কোটটা হ্যাঙারে ঝুলিয়ে রেখে যাব। অর্থাৎ, আমার গবেষণাগারটি যখন সমাজ, আমার পরীক্ষার বিষয়বস্তু যখন মানুষ, তখন সেটাকে শতকরা একশো ভাগ করাটা খুবই কঠিন। এবং সেটা ঘুরেফিরে ভাবনিষ্ঠ হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। এই তো ক’দিন আগে সেন্সাস হচ্ছিল। সেটি করার জন্য সরকারি কর্মচারীরাই বাড়ি বাড়ি এসেছেন। তাঁদের অনেকের মধ্যেও ফাঁকিবাজি রয়েছে। তাঁরা বাড়ি বাড়ি না গিয়ে নিজেরাই টিক মেরে দিয়েছেন অনেক ক্ষেত্রে। সেটি পাল্টা যাচাই করার ব্যবস্থা আমাদের দেশে সব সময় শক্তপোক্ত হয় না। আমরা কলেজ জীবনে সমাজতত্ত্বে ‘সার্ভে মেথডোলজি’ পড়েছিলাম। সেটি কিন্তু খুব কঠিন ব্যাপার।
নির্বাচনী সমীক্ষার জন্য আমরা কী করছি? বস্তুত, আমরা মানুষের নির্বাচনী ব্যবহারের সমীক্ষা চালাচ্ছি। সাংবাদিক হিসেবে নির্বাচন সমীক্ষা করতে গিয়ে বহু বার দেখেছি, অনেক সময় মানুষ সত্য কথা বলেন না। প্রত্যন্ত গ্রামের গরিব মানুষও হাওয়া বুঝে কথা বলেন। এবং বাইরে থেকে এসে এক দিনের জন্য একটি গ্রামে গিয়ে নাড়ি টেপা ডাক্তারের মতো সেই এলাকার সব মানুষের মুড বুঝে যাওয়াটা অবৈজ্ঞানিক। সে কারণে সংবাদপত্রের সাংবাদিকরা নির্বাচনী প্রচারের ধারা, রণকৌশল, সেখানকার মুড এ সবের উপর অনেক বেশি জোর দেন, ভবিষ্যৎবাণী করার থেকে।
এই পদ্ধতিতে নির্বাচনী ব্যবহারকে সমীক্ষা করাটাও এক ধরনের ‘এমপিরিক্যাল এভিডেন্স’। এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে একটি সত্যে পৌঁছনোর চেষ্টা। এখানে নমুনা যদি কম হয়, এবং তাতে বৈচিত্র্য না থাকে, তাতে কিন্তু ভুল হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। যেমন, আমরা সব সময় হাঁস সাদা হতেই দেখেছি। কিন্তু কালো হাঁসও দেখা গিয়েছে। এখন আমরা সেটি জেনেছি। রাসেল এক বার মজা করে লিখেছিলেন, অ্যারিস্টটল মনে করতেন, মেয়েদের দাঁতের সংখ্যা ছেলেদের থেকে বেশি। তাঁর এই ভ্রান্ত ধারণার কারণ, অ্যারিস্টটল দু’বার বিয়ে করলেও কখনওই তাঁর স্ত্রীদের দাঁত পরীক্ষা করে গুণে দেখেননি (রাসেল: দ্য ইমপ্যাক্ট অফ সায়েন্স অন সোসাইটি)।
সম্প্রতি সঞ্জয় কুমার এবং প্রভীন রাই ‘মেসারিং ভোটিং বিহেভিয়ার ইন ইন্ডিয়া’ শীর্ষক একটি বই লিখেছেন। সেই বইটিতেও বার বার দেখানো হয়েছে, কী ভাবে নির্বাচনী সমীক্ষাগুলি যতটা জনপ্রিয় ব্যবসাকেন্দ্রিক, ততটা গবেষণা নির্ভর নয়। এই সঞ্জয় কুমার ও প্রভীন রাই, দু’জনেই ‘দ্য সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ ডেভেলপিং সোসাইটিস’-এর (সিএসডিএস) গবেষক। এই বইটির মুখবন্ধে যোগেন্দ্র যাদব সিএসডিএস-এর ফেলো হিসেবে লিখেছেন, আমাদের দেশে এই সমীক্ষাগুলি বন্ধ করা উচিত নয়। বরং আরও দ্রুত এগুলিকে বৈজ্ঞানিক করে তোলার চেষ্টা করতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনী সমীক্ষাগুলির সবই মিডিয়ার ষড়যন্ত্র, এমন ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ মনোভাব নেওয়াটাও যেমন সমস্যা সমাধানের অতি সরলীকরণ চেষ্টা, তেমনই সংবাদমাধ্যমেরও কর্তব্য এই সমীক্ষাগুলিকে আরও বেশি করে গবেষণা নির্ভর, আরও বেশি সত্যের কাছাকাছি পৌঁছে দেওয়া। মানুষের চেতনা, মানুষের আচরণ দুই যোগ দুই করে আদৌ চার নয়। সমাজবিজ্ঞান আর পদার্থবিজ্ঞানের সেই ফারাক থেকেই যাবে। আজও তাই আমরা বলতে পারি না, আমি তোমাকে চার কিলো ভালবাসা আর পাঁচশো গ্রাম স্নেহ দিলাম। কিন্তু বৈজ্ঞানিক মানসিকতাকে বর্জন করে রাজনৈতিক মতলবের দাস হয়ে যাওয়াটা সব সময় অন্যায় এবং অনুচিত। |
পুরনো সমাচার: প্রকৃত গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গঠন কবে |
|
|
|
|
|