|
|
|
|
|
আত্মপরিচয়ের সংঘাত
কোন পথে নিয়ে যাবে
বাংলাদেশকে |
|
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বাংলাদেশকে ইসলামি রাষ্ট্রের তকমা থেকে বের করে
গণতন্ত্রী ধর্মনিরপেক্ষ
পথে হাঁটার সুযোগ এসেছে। শেখ হাসিনা সেই চেষ্টায়
আন্তরিক
ভাবে
ব্রতী হয়েছেন। কিন্তু সে পথটিও কণ্টকাকীর্ণ। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল |
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মহাস্মরণীয় দিন। সে দিন ঢাকায় প্রায় ৯০ হাজার পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে। জাতি লাভ করে এক অমূল্য সম্পদ— স্বাধীনতা। সে দিন তো শুধু সার্বভৌম এক রাষ্ট্রের প্রাপ্তি নয়, সংগ্রামের আর এক অধ্যায়ের শুরু। বাংলাদেশের মানুষ স্বপ্ন দেখেছিলেন, এই স্বাধীনতা নিয়ে আসবে আর্থিক অগ্রগতি। সামাজিক আশা-আকাঙ্খা পূর্ণ হবে। কিন্তু বাস্তবে হল অন্য!
এর পর ১৯৭৫-এর ১৫ অগস্ট। আর একটি সাঙ্ঘাতিক দিন। শেখ মুজিবের নিথর মরদেহ তাঁর বাড়ির সিঁড়ির
|
খালেদা জিয়া। |
|
শেখ হাসিনা। |
উপর পড়ে রইল। আর তাঁর দেহ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়া রক্তের ধারায় নীচতলার মেঝে পর্যন্ত রঞ্জিত হল।
অভ্যুত্থানকারী মেজররা পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে শেখ মুজিবের দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক সহকর্মী ও মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য খোন্দকার মোশতাক আহমেদকে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় বসালেন। নতুন রাষ্ট্রপতি খোন্দকার রেডিও ভাষণ দেন। প্রথম ভাষণেই তিনি শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডকে ঐতিহাসিক প্রয়োজন আখ্যা দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী সত্যিকারের বীরের মতো অকুতোভয় চিত্তে এগিয়ে চলেছেন। সে দিন কিন্তু তারা বাংলাদেশকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র বলে ঘোষণা করেনি। মোশতাক সুকৌশলে আওয়ামি লিগের দীর্ঘ দিনের সংগ্রামের ফসল, দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে অপরিবর্তিত রেখেছিলেন। তিনি ‘খোদা হাফেজ’ এবং ‘জয় বাংলার’ পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ বলে ভাষণ শেষ করেন। এর পর ২৬ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করা যাবে না এই মর্মে মোশতাক একটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন।
এই দু’টি ঘটনার প্রেক্ষাপটে যখন আজকের বাংলাদেশকে দেখি, তখন মনে হয় এই অশান্ত উত্তাল বাংলাদেশ আজও সেই চিরপুরাতন সত্তার সংঘাতে দীর্ণ। এ এক আত্মপরিচয়ের সংঘাত। এক দিকে বাংলাদেশের মানুষের ইসলামিক ধর্মীয় সত্তা, অন্য দিকে বাঙালি জাতি সত্তা। এই সংঘাত থেকে মানুষ বেরিয়ে আর্থিক উন্নয়ন ও বিকাশের ধ্বজা ওড়াতে চায়, কিন্তু পদে পদে সেই কাজে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ।
|
|
হিংসাদীর্ণ নির্বাচন। |
এ বারও বাংলাদেশের নির্বাচনের মুখে ২০১৩ সালের শাহবাগের বসন্ত আন্দোলন-৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি প্রদানের দাবিতে উত্তাল ঢাকাকে দেখেছি চোখের সামনে। পাকপন্থী ইসলামিক নেতা আব্দুল কাদের মোল্লাকে, যুদ্ধাপরাধের জন্য গঠিত ট্রায়াল ট্রাইবুনাল মৃত্যুদণ্ড দেয়। ৫ জানুয়ারি ভোটের কিছু দিন আগেই হাসিনা সরকার এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করায় ঢাকার রাজনীতিতে আরও মেরুকরণ পরিদৃশ্যমান হয়। জামাত-ই-ইসলামি এই ঘটনায় আরও জঙ্গি, আরও হিংসাশ্রয়ী হয়ে ওঠে। ভারতের বিদেশসচিব সুজাতা সিংহ ভোটের আগে যে দিন ঢাকায় যান ঠিক সে দিনই সংঘর্ষে সে দেশে ৮০ জন নিহত হল। ভোটের ফলাফল প্রকাশের পরেও সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর অত্যচার চলছে।
খালেদার জোটসঙ্গী জামাতের ভোটে লড়ার অধিকার নেই। কারণ বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতিই জামাত আনুষ্ঠানিক ভাবে অনাস্থা প্রকাশ করে। কিছু দিন আগে বাংলাদেশে পুরনির্বাচনগুলিতে যখন বিএনপি জয়লাভ করছিল, এমনকী, ঢাকার পুরনির্বাচন অর্ডিন্যান্স করে কেন পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে এই আওয়াজ তুলেছিল খালেদার দল, তখনও মনে হয়েছিল, ভোটের ফলাফল যা-ই হোক, বিএনপি নির্বাচনে সামিল হলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অভিমুখ সুনির্দিষ্ট থাকে। বিএনপি প্রতিষ্ঠিত এক রাজনৈতিক দল যারা সে দেশে দু’-দু’বার নির্বাচিত হয়েছে। শেখ হাসিনা ফোন করলেন খালেদা জিয়াকে। ভারতও চেয়েছিল যাতে খালেদা নির্বাচনে সামিল হন। খালেদা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার (আমরা বলি তদারকি সরকার) চেয়েছিলেন ঠিক সেই ভাবে তাতে রাজি হননি শেখ হাসিনা। কিন্তু এ কথাও সত্য, এ বার দেখা গেল ধীরে ধীরে বিএনপি অনেক বেশি জামাতের নিয়ন্ত্রণে চলে গেল।
উত্তর-শাহবাগ পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে গেল। খালেদা জিয়ার পুত্র তারিক রহমান দলের সহ-সভাপতি। তিনি বেশ কয়েক বছর ধরে লন্ডনে চিকিৎসাধীন। কিন্তু এ বারের ভোটের রণকৌশল রচনায় তার ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু লন্ডনে বসে তিনি বিবৃতি দিয়ে বলেন, ’৭২ সালের সংবিধানের উপর মানুষের কোনও আস্থা নেই। তারিক রহমানের এই বিবৃতি দেখে বোঝা যায় এই নবীন প্রজন্মের নেতা, যিনি খালেদার পর বিএনপি-র প্রধান কাণ্ডারী, প্রধান মুখ হবেন, তিনি কোন পথে বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে চাইছেন। |
|
এই হিংসার অবসান কবে? |
সামরিক শাসন তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের সমসাময়িক ইতিহাসের এক রূঢ় বাস্তবতা। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে সামরিক বাহিনী ৮৮ বার অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ৫২টি দেশে ক্ষমতা দখল করে। এশিয়া, আফ্রিকা, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার অনুন্নত দেশগুলিতে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রতিনিধিমূলক গণতান্ত্রিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে।
আসলে বাংলাদেশের সামরিক শাসনের পর্যালোচনা করতে গেলে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের পরিস্থিতিও স্মরণ করতে হবে। একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পর দারিদ্র্য, হতাশা, নৈরাজ্য, নীতিহীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী বহু অফিসারের মনে ক্ষোভেরও সঞ্চার করে। মুজিব সরকারেও দুর্নীতি বাসা বেঁধেছিল। বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সমর্পণের কথা বললে টাঙ্গাইলের বীর যোদ্ধা কাদের সিদ্দিকি তা মান্য করলেও জেলায় জেলায় অনেকেই তা করেননি। ইন্দিরা গাঁধী ঢাকায় গেলে তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেও মুজিব ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ঢাকা ছাড়ার অনুরোধ জানান। ইন্দিরা সঙ্গে সঙ্গে বলেন, মুজিব যে দিন চাইবেন সে দিনই ভারতীয় সেনা ফিরে যাবে। ১২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
কিন্তু তার পর বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ পথে নিয়ে যেতে পদে পদে বাধা পেয়েছে বাংলাদেশ। সামরিক শাসন ও মৌলবাদ হাত ধরাধরি করে হাঁটে। শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশে আর্থিক বৃদ্ধির হার ভারতের চেয়ে ঢের বেশি, এ কথা কমবেশি প্রায় সকল অর্থনীতিবিদই বলেছেন। বিশ্বব্যাঙ্ক এবং বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। সমস্যা হচ্ছে, উন্নয়ন বাধা পায় যখন বাংলাদেশে আবার ধর্মীয় মেরুকরণ প্রধান রাজনৈতিক উপজীব্য হয়ে ওঠে। |
|
মুজিবর রহমান। —ফাইল চিত্র। |
মুজিব বেঁচে থাকতে থাকতেই তাঁর কিছু ঘনিষ্ঠ সহযোগী ‘মুজিববাদ’ শব্দটি জনপ্রিয় করে তোলেন। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাই ছিল মুজিববাদের প্রধান উপাদান। মুজিব এক সাক্ষাৎকারে এ কথাও বলেন, বঙ্গসংস্কৃতি, ভাষা, লোকগাথা ও বাঙালি পরিবেশ থেকে মানুষ জাতীয়তাবাদের প্রেরণা পাবে। সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের মাধ্যমেই এক সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন মুজিবর। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খানের অনুপ্রেরণায় রব সিরাজ সমর্থিত ছাত্রলীগ ’৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে জয়লাভ করে। এই বামপন্থীরা মৌলবাদী জামাতে বিরোধী হলেও এই শক্তিও আদতে সে দিন মুজিবকে দুর্বল করে।
বাংলাদেশে সেই ট্র্যাডিশন আজও চলেছে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে বাংলাদেশকে ইসলামি রাষ্ট্রের তকমা থেকে বের করে গণতন্ত্রী ধর্মনিরপেক্ষ পথে হাঁটার সুযোগ এসেছে। শেখ হাসিনা সেই চেষ্টায় আন্তরিক ভাবে ব্রতী হয়েছেন। কিন্তু সে পথটিও কণ্টকাকীর্ণ। পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের বইমেলায় যখনই যাই দেখি তিনটি হুজুগ। কিছু স্টলে বিক্রি হয় মুজিবর রহমানের ছবি ও বই। কিছু স্টলে মার্কস-লেনিন-চে গুয়েভারা থেকে মুক্তিযোদ্ধা। তৃতীয় স্টলটি হল কোরান এবং ইসলামিক পঠন পাঠন।
আসলে এই তিনটি ভাবনার নির্যাসে কোনও বিরোধ নেই। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ থেকে ব্রিটিশরা মুসলমান ও বাঙালি সমাজে বিভেদনীতি এনেছিলেন। কিন্তু এই বিভেদ— অকাম্য। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র বাংলাদেশের চলার পথের মস্ত বড় শক্তি, কিন্তু মৌলবাদ মৌলবাদই। সেই মৌলবাদকে বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশ যদি এক সার্বভৌম ধর্মনিরপেক্ষ পথে হাঁটতে পারে তবে সে হবে বড় সুখের দিন। ভারতেরও লাভ তাতেই। |
ছবি: এএফপি। |
পুরনো সমাচার: ‘আপাতত বিপ্লব না হোক,
কিছু রিলিফ তো দিতে পারি’ |
|
|
|
|
|