|
|
|
|
|
কবিতা থেকে মিছিলে এসেছিলাম,
মিছিল থেকে কোথায় যাব |
|
ঘুণ ধরা দেওয়ালে চুনকামের সংস্কার হতে পারে, কিন্তু ব্যবস্থা বদলাতে
গেলে
দেওয়াল ভাঙতে হবে। কেজরিওয়ালের উত্থান নিয়ে লিখছেন
জয়ন্ত ঘোষাল |
লিওনার্দো ব্রেজনেভ সোভিয়েত রাশিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামের গরিব কৃষক পরিবারে জন্মেছিলেন। ১৯৬৪ সালে যখন তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হন তখন তিনি মস্কোতে মা ডেনি সোভনা নাটালিয়াকে নিয়ে এলেন। একটা বিশাল কালো গাড়িতে মা বসলেন, প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে তাঁর নৈশভোজ। তখন তাঁর মা ব্রেজনেভকে জিজ্ঞাসা করেন, হ্যাঁরে, এত প্রাচুর্য! কমিউনিস্টরা জানে তো! ওরা তোর এই স্বাচ্ছন্দ্য দেখে কিছু বলবে না তো!
এটা পুরনো গল্প। সত্যি কি না তা-ও জানি না। পড়েছিলাম চণ্ডী লাহিড়ীর রম্যরচনায়। কিন্তু আসল কথাটি হল আম আদমি যখন ক্ষমতার সিংহাসনে বসেন তখন এক রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু হতে বাধ্য। সেটাই সমাজবিজ্ঞান। প্রকৃতির আইন বা ‘ল অফ নেচার’।
বুঝতেই পারছেন, আজ আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু অরবিন্দ কেজরিওয়াল। কেজরিওয়াল কোনও এক ব্যক্তির নাম নয়। কেজরিওয়াল ভারতীয় রাজনীতির সাম্প্রতিকতম এক ‘ফেনোমেনন’। কংগ্রেস এবং বিজেপি— দু’টি বড় দলের উপর মানুষের বীতরাগ থেকে কেজরিওয়ালের জন্ম। কংগ্রেস ১৯৮৭ সাল থেকে ভারতের সিংহাসনে দীর্ঘসময় আসীন ছিল। তাই যাঁরা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করতে চান অথচ বিজেপি-কে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নন, বিশেষত নরেন্দ্র মোদী এবং মতাদর্শগত ভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে, তাঁরাও আজ অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরতে চাইছেন। |
|
মসনদে ‘আম আদমি’। ‘সিস্টেম’ মানবে তো? |
আসলে ১৯৫১ সালে জনসঙ্ঘ, ১৯৮০ সালে বিজেপি এ দেশে তাদের যাত্রাপথ শুরু করেছে। বিজেপি দিল্লির সিংহাসনে ছ’বছর রাজত্ব করেছে, তাতেও কিন্তু মানুষ হতাশই হয়েছে। মানুষ দেখেছে, বিজেপি-র মধ্যেও একই ভাবে দুর্নীতি, স্বজনপোষণের মতো নানা সঙ্কট। আমরা তখন বলতাম, বিজেপি-র কংগ্রেসিকরণ।
এই প্রেক্ষাপটে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের অভ্যুত্থান। দিল্লি ভারতের রাজধানী শহর। এই শহরের প্রদীপের নীচে যে কত অন্ধকার তা দিল্লিবাসী রোজ চাক্ষুষ করছে। দিল্লি তো ‘আ টেল অফ টু সিটিজ’। আমরা যারা দক্ষিণ দিল্লিতে থাকি, ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার আর হ্যাবিট্যাট, নর্থ ব্লক আর সাউথ ব্লককে দিল্লি ভাবি, তার বাইরে পুরনো দিল্লি, বহির্দিল্লির প্রত্যন্ত গ্রামে যান, দেখুন সে এক অন্য গরিব-গুর্বো মানুষের দিল্লি, নাগরিক অস্বাচ্ছন্দ্যের দিল্লি!
অরবিন্দ কেজরিওয়াল আজ তাই এক প্রতীক। আম আদমি-র প্রতিভূ। কার্টুনিস্ট আর কে লক্ষ্মণের ‘কমন ম্যান’। মানুষের প্রত্যাশা গগনচুম্বী। গণতন্ত্রে সংখ্যাই সাফল্যের প্রধান মাপকাঠি।
অরবিন্দ সংখ্যায় কম, কিন্তু এটাও ঘটনা যে এই নির্বাচনে মানুষ তাঁকেই চেয়েছেন। আমাদের টিভি চ্যানেলের এক গাড়িচালক ভোটের পর আমাকে বলেছিলেন, কংগ্রেস এবং বিজেপি, দু’টি দলই ভোটের আগে সাত দিন ধরে ‘লঙ্গর’ দিয়েছিল। অর্থাৎ বিনা পয়সায় গরিব মানুষদের খানাপিনা। ওই চালক আমায় বলেন যে তিনি সাত দিন ধরে দু’টি দলেরই বিনি পয়সার মহাভোজে নিয়মিত গিয়েছেন। মদ ও ডিনার-লাঞ্চ গ্রহণ করেছেন। কিন্তু ভোট দিয়েছেন ‘আপ’-কে। কারণ, কেজরিওয়ালের পার্টি এমন বিনি পয়সার ভোজ দেওয়ার মতো তামাসা করেনি।
দেখুন, মানুষ বোকা নন। মানুষকে কেন যে রাজনৈতিক নেতারা এত ‘আন্ডারএস্টিমেট’ করেন বুঝি না! অরবিন্দ তাই আজ স্বপ্নের সওদাগর! |
|
বালির লিখন: জয়ধ্বনি ‘আম আদমি’র। |
কিন্তু প্রশ্ন হল, ব্রেজনেভের মা যেমনটি ভেবেছিলেন তা নিয়ে! অরবিন্দ যা-ই বলুন না কেন তাঁর ভক্তদের অরবিন্দ প্রেম নিয়েও আমার কোনও কটাক্ষ নেই। সিনিসিজম-কে দূরে সরিয়ে রাখলেও বলব, কোনও ব্যক্তি অথবা এ হেন রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে থাকা একটি দল কি এই ব্যবস্থাকে বদলে দিতে পারে?
যদি অরবিন্দ পারেন, অন্য বহু আমজনতার মতোই খুশি হব। ভারত নামক দেশটিতে দুর্নীতি থাকবে না, ধর্ষণ হবে না, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসাম্য দূর হবে। কৃষক তার জমির অধিকার পাবে। শিল্পপতি সিঙ্গুরে তাঁর গাড়ির কারখানাও বানাবেন। ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লব লেনিনের নেতৃত্বে হয়। জারদের তাড়িয়ে সর্বহারার একনায়কতন্ত্র। সেই সোভিয়েত ইউনিয়নই তাসের ঘরের মতো ভেঙে গিয়েছে। ফুকোয়ামা লিখলেন, ‘এন্ড অফ হিস্ট্রি।’ চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও তার পরিণতি। নেপালেই দেখুন, প্রচণ্ড বিপ্লবী ছিলেন, ব্যবস্থায় এলেন মানুষের সমর্থন নিয়ে, আজ আবার ভোট যুদ্ধে পরাস্ত।
পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী আন্দোলন দেখুন। ১৯৬৯ সালের কমিউনিস্ট আন্দোলন, ১৯৭৭ সালে তীব্র কংগ্রেস
|
‘আমাদের লোক’ |
বিরোধিতার মধ্য দিয়ে বামফ্রন্ট হল ক্ষমতাসীন। তার পর কী হল? ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকার পর? সমাজব্যবস্থা বদলানোর জন্য কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় এসে এই ব্যবস্থার স্থিতাবস্থা রক্ষার জন্য তাঁরা নিজেরাই বদলে গেলেন। ‘শক্তি’ বা ‘ফোর্স’ হল পুরনো সমাজের ধাত্রী। তাই জন্ম হল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ঘরপোড়া গরুদের শঙ্কার মধ্যে কোনও মতলব নেই। কিন্তু রাজনৈতিক আবেগেরও স্থায়িত্ব থাকে। অনেকটা সোডার মতো। এই আবেগের শক্তিতেই ফরাসি বিপ্লব থেকে প্যারি কমিউন। এই রাজনৈতিক আবেগের অমর্যাদা করছি না। কিন্তু এই অস্থায়ী আবেগকে মূলধন করে এই ব্যবস্থাকে ভাঙা যায়?
যিশু খ্রিস্ট থেকে কার্ল মার্কস, বিবেকানন্দ থেকে আমাদের এই ব্যবস্থার মধ্যেও তাঁদের নন-কনফর্মিস্ট ভূমিকা ছিল। আজকের ভারতের সর্বশেষ নন-কনফর্মিস্ট এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আজকের অ্যান্টিসিস্টেম কেজরিওয়াল।
মার্কসবাদী অশোক মিত্র দুঃখ করে লিখেছেন, এই রাজনৈতিক পরিসরটি তো বামপন্থীদেরই ছিল। গরিব মানুষ, নিম্নবর্গের মানুষের কথা, স্বায়ত্তশাসন, শ্রেণিবৈষম্য ও দারিদ্র দূরীকরণের কথা তো তাঁরাই বলতেন। ১৯২৫ সালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম। আজ তারাই বা কেন গোটা দেশের মানুষের কাছে রাজনৈতিক বিকল্প হতে পারছে না?
কেজরিওয়াল নাগরিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছেন। অণ্ণা হজারের আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই ‘আপ’-এর জন্ম। কিন্তু এই আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে বদলাতে গেলে যে বিকল্প নীতি ও মতাদর্শের প্রয়োজন তা কি আছে কেজরিওয়ালের? না কি তার আজ আর প্রয়োজন নেই? না কি এই নীতি ও মতাদর্শ ছাড়া ব্যক্তির আবেগতাড়িত উদ্যোগে মৃতদেহের শরীরে শুধু আতর ছেটানোই হবে? ঘুণ ধরা দেওয়ালে চুনকামের সংস্কার হতে পারে, কিন্তু ব্যবস্থা বদলাতে গেলে দেওয়াল ভাঙতে হবে। ব্যবস্থার মধ্যে থেকে সে ব্যবস্থা ভাঙা কি সম্ভব? সত্যি কথা বলছি, এর উত্তর আমার জানা নেই। উত্তর খুঁজছি তো আমিও। কবিতা থেকে মিছিলে এসেছিলাম, আজ মিছিল থেকে কোথায় যাবো? |
ছবি: পিটিআই। |
পুরনো সমাচার: মোদীর নেতৃত্বে আসন
বাড়ানোই সঙ্ঘের অগ্নিপরীক্ষা |
|
|
|
|
|