ভয়াবহ এক পিপলি লাইভের কাহিনি
র্বভারতীয় এক সংবাদপত্রের বন্ধুবর ফেসবুকে রাজধানীতে নবাগত তাঁর এক সহকর্মীর বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন।
দক্ষিণ দিল্লিতে নবাগত ওই সংবাদকর্মী বাড়ি ভাড়া নিতে চাইছেন। একটি ফ্ল্যাট পছন্দ করে চুক্তি চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল তাঁর। হঠাৎ শেষ মুহূর্তে বাড়িওয়ালির প্রশ্ন, আপনি চুক্তিতে লিখেছেন ‘সার্ভিস’ কিন্তু ঠিক কী চাকরি করেন তা খোলসা করে বলেননি। পেশা সাংবাদিকতা শুনেই চুক্তিটি বাতিল করে দিলেন ওই বৃদ্ধা।
—না, না। মিডিয়াকে বাড়ি ভাড়া দেব না। আসলে বাড়িতে আমার এক ছোট মেয়ে আছে। আর একতলাতেই আমরা থাকব।
এ এক ভয়াবহ পিপলি লাইভ কাহিনি। তহেলকার চিঠি, অর্থাৎ তরুণ তেজপালের গোয়া কাণ্ডের পর এখন এটাই সাম্প্রতিকতম পাবলিক মুড। এই তহেলকাই দীর্ঘ দিন ধরে ন্যায়নীতির দীর্ঘ পাঠ দিয়ে এসেছে। এমনকী, দিল্লির সেই ভয়াবহ ধর্ষণের পর এই তেহলকাই ধর্ষণ আইনকে আরও কঠোর করার দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল। সংবাদমাধ্যমের প্রচারের চাপ রাজনৈতিক নেতাদের উপরেও প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছিল। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বিরলতম ঐকমত্য দেখা গেল। তার পর সংসদে আইন করে ধর্ষণের সংজ্ঞাকে আরও প্রসারিত করা হয়েছে। এখন ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুসারে শুধুমাত্র শারীরিক সঙ্গমই ধর্ষণের পূর্বশর্ত নয়, গোয়ার এক পাঁচতারা হোটেলে বন্ধ লিফ্টে সে দিন রাতে তরুণ তেজপাল যা যা করেছেন বলে অভিযোগ, সেটিও ধর্ষণের সংজ্ঞার আওতায় পড়ে।
সমস্যা হল কি জানেন?
ছবি: রয়টার্স।
দিল্লিতে সিকি-শতক একটানা বসবাস করায় এই তরুণ তেজপালদেরও আমি কিঞ্চিৎ চিনতে পারি। শাহি দিল্লির দরবারে এঁরা খুবই পরিচিত মুখ। যে কোনও সন্ধ্যায় পাঁচতারা হোটেলের যে কোনও পেজ থ্রি পার্টিতে এঁদের আমি সদাসর্বদা দেখি। তরুণ তেজপাল আসলে কোনও ব্যক্তি নন। তরুণ একটা সামাজিক বৈশিষ্ট্য বা ফেনোমেনন। এঁরা এমন এক পরিমণ্ডল, এমন এক বৃত্তে বসবাস করেন, যেখানে জীবনদর্শনের মন্ত্র একটাই। ‘ইট গোজ’, চলতা হ্যায়। এনিথিং হোয়াট উই ডু ইট গোজ!
সাধারণত উত্তর-বৈবাহিক যৌনকর্মে শ্লীলতাহানির ঘটনা বা মামলা তখনই রুজু হয় যখন সেখানে কোনও এক পক্ষের অভিযোগ আছে। দুই প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ-মানুষীর পারস্পরিক সম্মতি থাকলে ভারতীয় আইন অনুসারে কিছুই করার নেই। উচিত-অনুচিতের প্রশ্ন, যাকে বলে নৈতিকতার প্রশ্ন, তা প্রাসঙ্গিক ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ক্ষেত্রে। পরিবারের ভিতর কোনও পুরুষ এ হেন কাজ করলে স্ত্রী বা সন্তান নৈতিকতার প্রশ্ন তুলতে পারেন। পরিবার ও আত্মীয়তার প্রশ্নে পারস্পরিক সম্পর্ক ব্যাহত হতে পারে। কিন্তু এই তথাকথিত এলিট ব্যাভিচারী ব্যক্তিত্বদের পরিবারের মধ্যেও বহু ক্ষেত্রে দেখছি নৈতিকতা নামক বস্তুটিই অদৃশ্য। পারিবারিক নৈতিকতা একটি ‘মিথ’, বাস্তবতা নয়। লোক দেখানো।
হাতে হাত ধরে পার্টিতে ওঁরা আসেন, কিন্তু অনেকেরই যৌনজীবন বহুগামী। পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই বহুগামী। সেক্সকে বলা হচ্ছে ফান। অনেক সময় গ্রুপ সেক্স বা মুখোশ পরে পার্টনার বদলের খেলা হয় বহু ঘরোয়া পার্টিতে। পঞ্জাবিরা একটা কথা খুব বলেন, কোই গাল নেহি। এই প্রবচনের স্পিরিটটা খুব ভাল। অর্থ হল, কোনও ব্যাপার নয়। নো প্রবলেম। কুল। টেক ইট ইজি।
তরুণ তেজপালরা সেই একই কথা বলেন ভিন্ন প্রেক্ষিতে। তিনি এখনও বলছেন, কী এমন একটা মহা-অপরাধ করে ফেলেছি! এটা তো সামান্য একটু মজা। যখন প্রথম দিল্লি এসেছিলাম, তখন গোয়েন্দা বিভাগের এক বড়কর্তা বলেছিলেন, ‘মশাই, বিবেক জিনিসটা ঠিক কী, বলুন তো! ওটা দিল্লিতে ‘হাইলি সল্যুবল ইন হুইস্কি।’ সব গুলে যায়। দিল্লির এই ক্ষমতাবৃত্তে সবই ‘কুল’।
আসলে যৌনতা শব্দটি তো কোনও অন্যায় শব্দ নয়। অবশ্য, আমার নিজের মনে হয়, যৌনতা শব্দটির চেয়ে ‘সেক্স’ শব্দটিতে আরও বেশি নিরপেক্ষ মূল্যবোধ বা ভ্যালু আছে। যেমন সেকুলারিজম শব্দটি ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটির চেয়ে বেশি স্পষ্ট। দিবালোকের মতো। সেখানে কোনও মেঘ নেই। সেক্স যদি পারস্পরিক ভালবাসা, পছন্দ-বোঝাপড়ার ভিত্তিতে নির্মিত হয়, তবে সে প্রক্রিয়া নিয়েও সমাজের পঞ্চায়েত নেতাদের তর্জনী তোলা অনাধুনিক সামন্ত মনোভাব। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, যখন ভারতীয় পুরুষতন্ত্র বলপূর্বক যৌনতা চায়, তাতে কিন্তু শুধু যৌনতা নয়, ক্ষমতা (পাওয়ার) প্রদর্শনের দিক থাকে।
তখন এই পাওয়ার ট্রিপ ম্যাকিয়াভেলির পটভূমিতে অবতীর্ণ হয়। বিল ক্লিন্টন মনিকার সঙ্গে প্রেম করলে আপামর মার্কিন সমাজের তাতে সমস্যা কী? সমস্যাটা ব্যক্তিগত বা পারিবারিক। সমস্যা হতেই পারে হিলারি ক্লিন্টন বা কন্যা চেলসির। ক্লিন্টনের বিরুদ্ধে তাই যখন রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হল তখন কারণটি ছিল ভিন্ন। মহিলাটি হোয়াইট হাউসে ট্রেজারি দফতরের কর্মী। রাষ্ট্রপতির দফতর তার ক্ষমতা-প্রতিপত্তির অপব্যবহার করেছেন এটাই ছিল মূল অভিযোগ।
সমাজতাত্ত্বিকেরা বলেন, আঙ্কেল টমস কেবিনে দাসীদের বলপূর্বক ধর্ষণে আসলে ক্ষমতার বিষয়টিই যুক্ত ছিল। ‘দাস’, যাকে বলা হত ‘সাবজেক্ট’, তার উপর প্রভুত্বের এক বড় উপায় এবং নিদর্শন ছিল ‘যৌনতা’। পরিচারিকার উপর গৃহকর্তাদের ধর্ষণ (শ্যাম বেনেগালের ‘অঙ্কুর’-এর কথা মনে পড়ে) একই সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের অন্তর্ভুক্ত।
মনে পড়ে, রাজীব গাঁধীর সময় উত্তরপ্রদেশের জেড আর আনসারি কেন্দ্রীয় পরিবেশমন্ত্রী ছিলেন। তিনি উদ্যোগ ভবনে তাঁর চেম্বারে এক মহিলার উপর বলপূর্বক ধর্ষণের চেষ্টা করেছিলেন। ওই মহিলার অভিযোগের ভিত্তিতে ওই মন্ত্রী মহোদয়ের চাকরি চলে যায়।
একটা ঘটনা মনে পড়ছে রাজীব গাঁধীর সময়কার। ২৪ আকবর রোডে কংগ্রেসের সদর কার্যালয়ে সে দিন বিপুল ভিড়। আজকের মতো সে দিনও ছিল নির্বাচনী মরসুম। টিকিট শিকারির দল আসছে কাতারে কাতারে। কংগ্রেসের এক প্রবীণ নেতা ছিলেন, তাঁর নাম ছিল বি পি মৌর্য। এখন তিনি প্রয়াত। তা এ হেন দলিত নেতাটির সাধারণ সম্পাদকের ঘরে এক মাঝবয়সী সুশ্রী মহিলা এসে মৌর্যকে বললেন, আমি এ বারের ভোটে কংগ্রেসের প্রার্থী হতে চাই। এই আমার বায়োডেটা। তা মৌর্য ওই মহিলাকে বললেন, সীতা না দৌপ্রদী, কে আপনার প্রিয় চরিত্র? সঙ্গে সঙ্গে ওই মহিলা বললেন, সীতা। তিনি তো আমাদের সকলের সীতা-মা।
আমাদের সামনেই মৌর্য ওই মহিলাকে বলেছিলেন, তা হলে আপনার টিকিট হবে না। কারণ, কংগ্রেসের টিকিট পেতে গেলে এক জন নয়, কমপক্ষে পাঁচ জন নেতাকে সন্তুষ্ট করতে হবে। জানি না, আজকের প্রেক্ষিতে এই উক্তির ভিত্তিতেও ওই মহিলা যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনতে পারেন কি না! তবে বলপূর্বক ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনা সব সময়ই ক্ষমতার ব্যাভিচার। যৌনতা সেই ক্ষমতার স্বৈরাচারের একটা ক্ষুদ্র ফর্ম মাত্র।
তরুণ তেজপালদের বৃত্তটি ক্ষমতার বৃত্ত। এই ক্ষমতার রাজনীতিতে রাজনৈতিক দল কিন্তু প্রধান বিষয় নয়। আলোচনাটিকে কংগ্রেস বা বিজেপি-র ভেদাভেদ হিসেবে দেখাটা অবৈজ্ঞানিক। তহেলকা এনডিএ জমানায়, অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায় জর্জ ফার্নান্ডেজের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছিল। অতএব বিজেপি গোয়া সরকারের সাহায্য নিয়ে তহেলকা বিরোধী অভিযান চালাচ্ছে।
ক’দিন আগেই নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে এক মহিলার উপর গুজরাত পুলিশের নজরদারির ঘটনা তহেলকাই প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছিল। অতএব এটি হল বদলার রাজনীতি। এই কংগ্রেস বনাম বিজেপি-র অভ্যন্তরীণ লড়াইটা অসত্য বা এর কোনও বস্তুগত বৈধতা নেই এমন কথা বলছি না। কিন্তু রাজনীতির ছাত্র হিসেবে এ-ও জানি, ভারতের সব ঘটনাতেই দলীয় রাজনীতি এসে যায়। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ রেষারেষি, পারিবারিক কলহতেও যেমন সিপিএম-তৃণমূল এসে যায়। পুকুরে ফলিডল দিয়ে মাছ মারা বা বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়াতেও রাজনৈতিক দল সামিল হয়। সেই দলীয় কোন্দলকে এক পাশে সরিয়ে আমাদের যৌন হেনস্থার বিষয়টি দেখতে হবে।
কার্ল মার্কস তাঁর শ্রেণি সংঘাতের তত্ত্বের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের কথা বলেছিলেন। তার মধ্যে হয়তো এক ধরনের অর্থনৈতিক নির্দেশ্যবাদ বা ইকনমিক ডিটারমিনিজিম ছিল। পরবর্তী উত্তর-আধুনিকতা পর্বে ফুকো-দেরিদা-লিওতার-দ্যলুজ-বদ্রিলার-লাকাঁ প্রমুখের আধুনিক ও উত্তর কাঠামোবাদী চিন্তা-ঘরানা ক্ষমতা সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে আরও স্বচ্ছতর করেছে। আমরা বুঝতে পেরেছি, ক্ষমতা শুধু অর্থনীতি নয়। ক্ষমতা সামাজিক সংস্কৃতি ও জ্ঞানের সঙ্গেও যুক্ত।
তরুণ তেজপাল অ্যান্ড কোম্পানি রাজধানীর পিরামিডের উচ্চ মাচায় আসীন। সামাজিক ক্ষেত্রে এঁরা হলেন সব কেউকেটা। এক এক জনের অঙ্গুলি হেলনে বহু মন্ত্রী ও শিল্পপতি ওঠেন-বসেন। গ্রামীণ ভারতের লোকায়ত জনজীবনের সঙ্গে এঁরা কোনও ভাবেই যুক্ত নন। অথচ এঁরাই ইন্ডিয়া গেটের সামনে মোমবাতি নিয়ে হাঁটেন ধর্ষণের প্রতিবাদে। মিছিল করে এঁরাই আবার অবতীর্ণ হন ধর্ষকের ভূমিকায়।
সত্য সেলুকাসদা, আজকাল আপনিও আর বিস্মিত হন না!



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.