|
|
|
|
|
প্রকৃত গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ
বাংলাদেশ গঠন কবে
ধর্মীয় গোঁড়ামির সঙ্গে বাঙালির মুক্তমনা
জাতিসত্তার
সংঘাত থেকেই গেল। লিখছেন
জয়ন্ত ঘোষাল |
|
কথোপকথন হল গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শক্তি। গত বুধবার ‘শাহি সমাচার’-এ বাংলাদেশ সংক্রান্ত নিবন্ধটি পড়ে বহু মানুষ অনেক প্রশ্ন তুলেছেন। অনেকে অনেক মতামতও জানিয়েছেন। ফেসবুকেও অনেক আলোচনা হচ্ছে। সাধারণত একই বিষয়ে আবার লিখি না। কিন্তু পাঠকের দাবিতে আর এক বার বিষয়টির একটি ভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনায় ব্রতী হচ্ছি।
বাংলাদেশের আত্মপরিচয়ের সংঘাত নিয়ে আগের আলোচনাটি ছিল মূলত আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিষয়কেন্দ্রিক। কিন্তু রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য আমার লেখার প্রেক্ষিতে বিষয়টিকে উর্দু বনাম বাংলাভাষার সংঘাতের ইতিহাসের নিরিখেও দেখতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। মহম্মদ আলি জিন্না ঢাকায় এসে ঘোষণা করেন, উর্দু, শুধুমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তার বিরুদ্ধে সে দিনের পূর্ববঙ্গে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা সকলের জানা। ’৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কয়েক মাসের মধ্যেই বাংলাভাষাকে কেন্দ্র করে ’৪৮ সালের প্রথম দিকেই ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়।
ফেসবুকে কৌশিক ভাদুড়ি এবং মইদুল ইসলাম বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন। ওঁরা বলছেন, মুসলমান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক সত্তার থেকে জিহাদি ইসলামিস্টকে আলাদা করতে হবে। আবার ধর্মীয় মুসলমান যেমন আছেন, তেমনই আবার জন্মসূত্রে বহু মুসলমান প্রাত্যহিক জীবনে ইসলাম বর্ণিত জীবন পালন না-ও করতে পারেন। সে অধিকারও মানুষেরই অধিকার। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সমাজে এক ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদও রয়েছে, তাকেও গুরুত্ব দিতে হবে। পাকিস্তান শারিয়ারপন্থী না হয়ে হানাফিপন্থী ইসলামকে তাদের সংবিধানে প্রয়োগ করতে চেয়েছে, এ কথাও মইদুল ইসলাম জানিয়েছেন। সুন্নি মুসলমানের ঐতিহ্য অনুসারে ইরাকের আবু হানিফা এই ইসলামিক ন্যায় ও নীতি প্রতিষ্ঠা করেন। পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলমান রাষ্ট্র ও সমাজ এই ধারা মেনে চলছেন। অন্য দিকে, আরবি ভাষার মানুষ মুসলিম জীবনবিধির এক আইনগত নিয়মাবলী তৈরি করেন, তাকে বলা হয় শারিয়া। জিন্নার পাকিস্তান সাংবিধানিক ভাবে শারিয়া নয়, হানাফি পদ্ধতিকে বেশি অনুসরণ করেছে। এই দুই ধারার পার্থক্য অবশ্য আজকের আলোচনার বিষয় নয়। বিষয় হল, বাংলা সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদকে প্রাধান্য না দেওয়া নিয়ে। |
|
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। —নিজস্ব চিত্র। |
’৪৭ সালের ১৪ অগস্ট দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। ’৫১ সালে পাকিস্তানের প্রথম আদমশুমারিতে দেখা যায় যে মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৪.৬০ ভাগ বাংলা, ২৮.০৪ শতাংশ পঞ্জাবি, ৫.৮ সিন্ধ্রি, পশতু ৭.২ শতাংশ, উর্দু ও বাকি ১.৮ শতাংশ ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষাভাষী নাগরিক। অনেকে নিজেদের দ্বিভাষী বলে উল্লেখ করেছিলেন। উর্দু ছিল পাকিস্তানি ভাষাভাষীর দিক থেকে তৃতীয় স্থানে। অন্য দিকে, তদানীন্তন পূর্ববাংলার ৪.৪০ কোটি জনসংখার মধ্যে ৪.১৩ কোটি ছিল বাংলা ভাষাভাষী। এখানে ৯৮ শতাংশ বাংলা এবং মাত্র ১.১ শতাংশ ছিল উর্দুভাষী। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন ছিল, শারিয়াই হোক আর হানাফি— কোন মতে বাংলভাষাকে উপেক্ষা করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী?
১৯০৬ সালে যখন নিখিল ভারত মুসলিম লিগ প্রতিষ্ঠিত হয় তখন সেই প্রথম অধিবেশনেও এ প্রশ্ন ওঠে। ’৩৭ সালে মুসলিম লিগ সভাপতি জিন্নাহ উর্দুকে দলের দফতরি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করলে ফজলুল হক তার বিরোধিতা করেন। কিন্তু তাতে কোনও লাভ হয়নি। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ববাংলার নতুন দল আওয়ামি মুসলিম লিগ গঠন কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানে প্রথম বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে অল্প সময়ের মধ্যে দলটি প্রকৃতই আওয়ামি অর্থাৎ জনগণের দলে পরিণত হয়। মুসলিম লিগ সরকার ও দল হিসেবে দেশ পরিচালনায় চরম বৈষম্য ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার ও দমন নীতি অনুসরণ করেছিল। এরই প্রতিবাদস্বরূপ মুসলিম লিগের এক দল আত্মসচেতন উদারপন্থী ও অসাম্প্রদায়িক তরুণ রাজনৈতিক কর্মী এই দলটি গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এর ফলে বাংলাদেশের রাজনীতি উচ্চবিত্ত ও নবাব পরিবার থেকে ক্রমান্বয়ে মধ্যবিত্তের কাছে চলে আসে। নবগঠিত আওয়ামি মুসলিম লিগ ক্রমান্বয়ে অসাম্প্রদায়িক দলে পরিণত হয়। মুসলিম লিগের অনাচার ও ব্যর্থতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। |
|
ছবি: এপি। |
বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামি মুসলমি লিগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কিন্তু ছিল পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা ও স্থায়িত্বে সংরক্ষণ, পাকিস্তানের সংবিধান ও আইনকে সত্যিকারের গণতন্ত্রের উপর প্রতিষ্ঠা করা, পাকিস্তানের মুসলমানদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, সামাজিক শিক্ষার স্বার্থ নিশ্চিতকরণ।
১৯৫৫ সালে আওয়ামি মুসলিম লিগের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে অন্য ধর্মাবলম্বীদের জন্যও দ্বার উন্মুক্ত হয়। এই পরিবর্তন বাঙালি সত্তাকে বাংলাদেশের ধর্মীয় সত্তার চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে দেয়। এ কাজটি সঠিক না বেঠিক ছিল, সেই বিতর্কও হতে পারে, কিন্তু সেই বিতর্কে প্রবেশ না করেও বলা যায়, মুসলিম লিগের উর্দু জাতীয়তাবাদকে চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে আওয়ামি লিগ বাংলা জাতীয়তাবাদকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ’৫৪ সালের নির্বাচন পূর্ববাংলার সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত প্রথম অবাধ নির্বাচন। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ভাবে ক্ষমতাসীন মুসলিম লিগকে ব্যালটের মাধ্যমেও প্রত্যাখ্যান করে।
পাকিস্তানি আমলের প্রায় ২৪ বছরের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পর্ককে বাঙালি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা কেউ কেউ অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ বলে অভিহিত করেছেন। আর্থিক, সামাজিক, রাজনৈতিক বৈষম্য তো ছিলই। সরকারি পদেও পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা ছিলেন খুবই কম। ’৭১ সালের পর অবশ্য মুজিব সরকারের প্রশাসনের মধ্যেও দুর্নীতি, স্বজনপোষণ বাসা বাধে এবং পরবর্তীকালে জেনারেল এরশাদকে ঠেকাতে শেখ হাসিনাকে জামাতের সাহায্য নিতে হয়। পরবর্তীকালে বাঙালি জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি মুসলিম সত্তার সুরক্ষার নামে মুসলিম লিগের পুরনো ভোটব্যাঙ্ক সম্পর্কেও কিঞ্চিৎ নরম মনোভাব নিতে হয়। তখন প্রশ্ন ওঠে, ক্ষমতার রাজনীতির এই আপোস ঢাকার রাজনীতিতে ভবিষ্যতে বিপদ ডেকে আনবে না তো?
বাংলাদেশের জামাত তাদের নামকরণে যে বদল এনেছিল, তাতেও বোঝা যায় যে জামাতও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে খারিজ না করে এক নতুন রণকৌশল নিতে চেয়েছে। পুরনো বোতলে নতুন মদ পরিবেশনের চেষ্টা তারাও করেছে। জামাত-ই-ইসলামি এক আন্তর্জাতিক গোঁড়া সুন্নি মুসলিম ধর্মীয় সংগঠন, যার জন্ম ১৯৪১ সালে। কিন্তু পরে জামাত নামটা বদলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সঙ্গেই ঢাকার রাজনীতিতে নিজেকে যুক্ত করে এক নতুন ইসলামি রাজনৈতিক প্যাকেজ তৈরি করতে চায়। কিন্তু আদতে তাঁদের গোড়ামি থেকেই গিয়েছে, যা আসলে বাঙালির মুক্তমনা জাতিসত্তার সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি করে।
প্রশ্ন, এ বার শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বাংলাদেশে এই মেরুকরণের সংঘাত বাড়ানোর শক্তিকে নির্মূল করে আধুনিক গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিশালী বাংলাদেশ গঠন সম্ভব কি হবে? বাংলাদেশ আজ এক যুগ সন্ধিক্ষণের মুখে দাঁড়িয়ে। পথের শেষ কোথায় জানি না। আশাবাদী হতে ক্ষতি কী? |
গ্রন্থঋণ: ১) বাংলাদেশের ইতিহাস ১৯০৫-১৯৭১— আবু মোঃ দেলোয়ার হোসেন
২) বাংলাদেশ পলিটিক্স- প্রবলেমস অ্যান্ড ইস্যুস।— রউনাক জাহান |
পুরনো সমাচার: আত্মপরিচয়ের সংঘাত কোন পথে নিয়ে যাবে বাংলাদেশকে |
|
|
|
|
|