কিছুটা সময় নষ্ট হলেও শেষ পর্যন্ত বর্ধমানের কাটোয়ায় এনটিপিসি-র প্রস্তাবিত তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য জমির সমস্যা মিটতে চলেছে। মঙ্গলবার শিলিগুড়িতে নবনির্মিত মিনি সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে, এই প্রকল্পের জন্য এনটিপিসি-কে প্রায় ১০০ একর সরকারি জমি দেওয়া হবে। আর এই সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজ্যের বিদ্যুৎ শিল্পে ঝুলে থাকা প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ এক রকম পাকা করে ফেললেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শিল্পমহলের মতে, মিৎসুবিশির পর এনটিপিসি-র প্রকল্পের জট ছাড়িয়ে ইতিবাচক বার্তা দিল নবান্ন।
মুখ্যমন্ত্রী নিজে এ দিন বলেন, “কাটোয়া প্রকল্পটি বেশ কিছু দিন ধরেই পড়ে রয়েছে। ওদের জমি এবং কয়লা নিয়ে কিছু সমস্যা ছিল। দু’টি ক্ষেত্রেই আমরা সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” তিনি জানান, এ জন্য সরকারের নীতি মেনেই জোর করে জমি নেওয়া হচ্ছে না। সরকারের বিভিন্ন দফতরের হাতে থাকা ৯৮ একরের মতো জমি এনটিপিসি-র হাতে তুলে দেওয়া হবে। পাশাপাশি, এই প্রকল্পের জন্য কয়লা দেওয়া হবে বীরভূমের ডেউচা-পাঁচামি খনি থেকে। সেখান থেকে কয়লা পেতে কোনও কারণে দেরি হলে অন্য খনি থেকে কয়লা দেওয়ার ব্যবস্থা করবে রাজ্য। |
জমি এবং কয়লা সমস্যা মিটে যাওয়ায় কাটোয়ায় তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প গড়তে আর বাধা থাকা উচিত নয় বলেই মনে করছে রাজ্য। রাজ্যের সিদ্ধান্তের কথা জেনে এনটিপিসি-র চেয়ারম্যান অরূপ রায়চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া, “সরকারের সিদ্ধান্তে আমরা খুশি। প্রথম থেকেই কাটোয়া প্রকল্প নিয়ে আশাবাদী ছিলাম। এই প্রকল্প আমরা গড়বই।”
বাম আমলে হাতে নেওয়া কাটোয়া তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য গোড়ায় ১১০০ একর জমি নেওয়ার কথা ছিল। বলা হয়েছিল, বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে ১৬০০ মেগাওয়াট। সেই মতো জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। বাম আমলেই নেওয়া হয় ৫৬৫ একর জমি। কিন্তু আড়াই বছর আগে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পরেই বন্ধ হয়ে যায় জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া। কারণ, রাজ্য সরকার জানিয়ে দেয়, তারা কোনও প্রকল্পের জন্য এক ছটাকও জমি নেবে না। জমি সরাসরি মালিকদের কাছ থেকে কিনে নেতে হবে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকেই। নানা বাস্তব অসুবিধার কারণে যে কাজে খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি ওই কেন্দ্রীয় সংস্থাটি।
পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে বুঝে পরিকল্পনা পাল্টে এনটিপিসি জানায়, তারা ১৩২০ মেগাওয়াটের প্রকল্প করতে চায়। এর জন্য অধিগৃহীত ৫৬৫ একরের সঙ্গে আর মাত্র ১৫০ একর জমি পেলেই চলবে। কিন্তু সেই জমিও সরকার জোগাড় করে দেবে, না সংস্থাকেই কিনে নিতে হবে, তা নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত প্রায় একশো একর জমির ব্যবস্থা করে দিয়ে সমস্যা অনেকটাই মিটিয়ে দিচ্ছে রাজ্য। বাকি ৫০ একরের মতো জমি কেনার ব্যাপারেও রাজ্য সরকার অনুঘটকের কাজ করবে বলে মনে করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই এই জমি কিনতে চেয়ে জমি মালিকদের কাছ থেকে সম্মতিপত্র চেয়েছে এনটিপিসি। ৯৭ শতাংশ মালিকই জমি দিতে রাজি বলে সংস্থা সূত্রে খবর।
নিজের ঘোষিত নীতি থেকে সরে না-এসেও রাজ্য যে ভাবে কাটোয়ার সঙ্কট কাটাতে এগিয়ে এল, তাতে উৎসাহিতই বোধ করছে শিল্প মহল। এক শিল্পপতির কথায়, “খাতায়-কলমে রাজ্য সরকারের নীতির পরিবর্তন না-হলেও শিল্পের জমি নিয়ে তাদের মনোভাবে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জমি সমস্যা মেটাতে সক্রিয় ভূমিকা নিতে শুরু করেছে তারা।”
মুম্বইয়ে মমতার শিল্প সম্মেলনের পর থেকেই রাজ্য সরকারের মনোভাবে এই ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করছে শিল্পমহল। এই সম্মেলনের পরেই নতুন শিল্প ও বস্ত্রনীতি ঘোষণা করেছে রাজ্য। শিল্পায়নে গতি আনতে ‘টাস্ক ফোর্স’ গঠন করা হয়েছে। বড় শিল্প প্রকল্পের পথে বাধা কাটাতে কর্পোরেট দুনিয়ার ধাঁচে শিল্প দফতরের এক এক জন আধিকারিককে ‘রিলেশনশিপ ম্যানেজার’ হিসাবে নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। জেলায় শিল্পোদ্যোগী তৈরি করতে কর্পোরেট জগতের হাত ধরছে রাজ্য। আবার, লগ্নি-প্রকল্পের জট কাটাতে বিশেষ নজরদারি গোষ্ঠী গঠনের কথাও বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। কেন্দ্রের ধাঁচে ১০০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগের প্রকল্পে জট কাটাতেই এই বিশেষ গোষ্ঠীর জন্ম, যা পশ্চিমবঙ্গের আগে আরও সাতটি রাজ্য গঠন করেছে। পাশাপাশি, কর্মদক্ষতার তুল্যমূল্য বিচার করে শিল্পমন্ত্রীও বদল করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এর পরেই তৎপর হয়ে হলদিয়ার মিৎসুবিশি প্রকল্পের জট ছাড়িয়েছে রাজ্য। বিদেশি লগ্নি টানার লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, মিৎসুবিশির কারখানায় যে পরিমাণ পুঁজি বিনিয়োগ হয়েছে, তার ১২৫% ভ্যাট সংস্থাকে ফেরত দেওয়া হবে। পাশাপাশি, ওই কারখানায় বাণিজ্যিক উৎপাদন চালু হলে পাঁচ বছর পর্যন্ত মিলবে বিদ্যুৎ মাসুলে ছাড়।
আর হলদিয়ার পরে কাটোয়া। নবান্ন সূত্রের খবর, প্রকল্প এলাকার লাগোয়া ও আশপাশে ছড়িয়ে রয়েছে সরকারের খাস এবং সেচ, পঞ্চায়েত, কৃষির মতো কয়েকটি দফতরের জমি। সেই জমি এনটিপিসি-র হাতে তুলে দেওয়া হবে। মুখ্যমন্ত্রী জানান, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন নিগমের নিজস্ব খনি থেকে কাটোয়া তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য কয়লারও ব্যবস্থা করা হবে। জমি এবং কয়লা দেওয়ার শর্ত হিসেবে কাটোয়া প্রকল্পের উৎপাদিত বিদ্যুতের ৮৫% সরকারকে দিতে হবে।
এনটিপিসি সূত্রে খবর, সরকারের এই সিদ্ধান্ত তাদের পরিচালন পর্ষদের পরবর্তী বৈঠকে পেশ করা হবে। সরকার ইতিবাচক মনোভাব দেখানোয় পর্ষদও প্রকল্প নির্মাণে সবুজ সঙ্কেত দেবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
রাজ্য সরকারের নতুন স্লোগান হল, ‘শিল্প করুন, বাংলা গড়ুন’। পরিবর্তিত মনোভাবে ভর করে এই স্লোগান সফল হবে বলেই সরকারের শীর্ষ কর্তাদের আশা। |