|
|
|
|
জাঁদরেল পুলিশ কবিতাকে কুর্নিশ |
সুমন ঘোষ • মেদিনীপুর |
যে হাতে রাঁধাবাড়া, সে হাতেই অনায়াস দক্ষতায় বন্দুক চালানো।
কুখ্যাত সমাজবিরোধীদের গরাদে ভরা থেকে আদালতে কড়া চার্জশিট জমা দেওয়া সাহসের অভাব নেই কোনও পরিস্থিতিতেই।
তাঁর এই কর্মনৈপুণ্যের স্বীকৃতি হিসেবেই ‘চিফ মিনিস্টার মেডেল ফর বেস্ট ইনভেস্টিগেটিং অফিসার ২০১২’-র সম্মান পেয়েছেন পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মহিলা সাব ইন্সপেক্টর কবিতা দাস। রাজ্যের জেলা পুলিশ ও কমিশনারেটের আওতাধীন পুলিশ কর্মীদের দু’জনকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। কবিতাদেবী ছাড়াও এই সম্মান পেয়েছেন দক্ষিণ দিনাজপুরের জয়ন্ত দত্ত।
ভাল কাজের স্বীকৃতি হিসেবে প্রতি বছরই পুলিশকর্মীদের পুরস্কৃত করা হয়। দেওয়া হয় শৌর্যপদক, নিষ্ঠাপদক, সেবা পদক। দু’বছর হল, এরই সঙ্গে যোগ হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর মেডেল। রাজ্যের চারজনকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। সিআইডির দু’জন এবং জেলা পুলিশ ও কমিশনারেট মিলিয়ে দু’জনকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। সিআইডি-র পক্ষ থেকে এ বার ডিএসপি তাজ মহম্মদ ও সাব ইন্সপেক্টর সৌগত ঘোষ এই মেডেল পেয়েছেন। গতবার সিআইডির শর্বরী ভট্টাচার্য এই পুরস্কার পেয়েছিলেন। তবে জেলা ও কমিশনারেটের আওতাধীন মহিলা অফিসার হিসাবে কবিতাই প্রথম এই পুরস্কার পেলেন। |
|
নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কবিতা দাস।—নিজস্ব চিত্র। |
১৯৯৮ সালে পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর হিসাবে কর্মজীবন শুরু কবিতাদেবীর। প্রথমে বাঁকুড়া জেলার বাঁকুড়া থানা ও বিষ্ণুপুর থানায় কাজ। পরে পশ্চিম মেদিনীপুরের কোতয়ালি থানায় বদলি হন তিনি। বছর চারেক হল কবিতাদেবী এসওজি সেলের ওসি-র দায়িত্বে রয়েছেন। ফলে বর্তমানে তদন্তের কাজ নেই। তা সত্ত্বেও তাঁর সার্ভিস বুক বলছে, তিনি বিগত দিনেই প্রায় হাজার খানেক ঘটনার তদন্ত করেছেন। যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্ত করেছেন আড়াইশোরও বেশি। সব মামলাই মূলত, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, মহিলা পাচার সংক্রান্ত। তার মধ্যে ৬টি ঘটনায় অভিযুক্তরা সাজা পেয়েছে। তার মধ্যে যাবজ্জীবনও রয়েছে। যাবজ্জীবন সাজার থেকেও অন্য একটি সাজাকে বেশি গুরুত্ব দিতে চান কবিতাদেবী। তা হল, পাঁচ বছরের ভাইঝিকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছিল ৪০ বছরের কাকার। তদন্ত করেছিলেন কবিতাদেবী। মেদিনীপুর জেলা আদালত ৮ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছিল। ওই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে হাইকোর্টে গিয়েছিলেন অভিযুক্তপক্ষ। কবিতাদেবীর কথায়, “হাইকোর্ট অভিযোগের সমস্ত দিক বিচার করে আরও ২ বছরের সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছিল। এটাই আমার কর্মজীবনে সব থেকে উল্লেখযোগ্য ঘটনা।” এসওজিতে থাকার সুবাদে কুখ্যাত ডাকাতদের খোঁজখবর দেওয়া থেকে শুরু করে মাওবাদী দমনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তাঁর।
কর্মজীবনের পাশাপাশি তিনি সংসারও সামলান সমান দক্ষতায়। বাড়িতে রান্না করেন। ছেলে বার্ণিক চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। পূরণ করতে হয় ছেলের আবদারও। সংসারের যাবতীয় কাজ সামলে পুলিশের চাকরিতে সমান স্বচ্ছন্দ তিনি। থানাতে কাজ করার সময় সকলের সঙ্গেই সদ্ব্যবহার করা নিয়ে তাঁর যেমন সুনাম ছিল, তেমনই কড়া ধাঁচের অফিসার বলে ‘বদনাম’ও ছিল। তদন্ত করতে গিয়ে অনেক সময় নানা দিক থেকে চাপ আসেনি তেমন নয়। কিন্তু সেই চাপ অগ্রাহ্য করেই তিনি কাজ করে গিয়েছেন। চলতি মাসের ৭ তারিখে তাই মেডেল ও সঙ্গে চল্লিশ হাজার টাকার চেক পেয়ে বেজায় খুশি কবিতাদেবী। তাঁর কথায়, “স্বীকৃতি কার না ভাল লাগে। স্বীকৃতির সম্মান ধরে রাখতে দায়িত্ব আরও বাড়ল।”
পুরস্কার পাওয়ার পরেই কবিতাদেবীর মনে ভেসে উঠছিল শৈশবের চেনা ক্যানভাসের ছবিগুলো। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার কেশিয়াড়িতে জন্ম। বাবা চাষ করেই তিন বোন ও এক ভাইকে পড়াশোনা করাতেন। ফলে বিলাসিতা দূরের কথা, ন্যূনতম খরচেই সংসার টেনেটুনে চালাতে হত। জীবনযুদ্ধে হাল না ছেড়ে কবিতাদেবী ১৯৯৭ সালে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এমএ পাশ করেন। ১৯৯৮ সালে বিএড পড়তে পড়তেই পুলিশে চাকরি। বিএড পড়া ছেড়ে চাকরিতে যোগ। কবিতার কথায়, “তখন ভাবার সময় ছিল না। হয়তো আরও পড়াশোনা করলে অন্য কিছুও হতে পারতাম। কিন্তু পরিবারের কথা ভেবে চাকরি নিতেই হল।” চাকরিতে অবশ্য পদস্থ আধিকারিকদের সাহায্য পেয়েছেন সব সময়েই। কবিতার কথায়, “পদস্থ আধিকারিকদের সাহায্য না পেলে এই স্বীকৃতি পেতাম না।” ঝাড়গ্রাম ও মেদিনীপুর পুলিশ জেলার ৭ জন অন্য পুরস্কারও অবশ্য পেয়েছেন। কেউ সেবাপদক আবার কেউ প্রশংসা পদক। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কালীপদ কারক, অভিজিত্ সাউ, প্রদীপ দত্ত, গীতানুরঞ্জন দাস, রঞ্জিত সরকার, সুজিত মজুমদার ও চন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। সে তালিকায় অবশ্য মহিলা অফিসার নেই।
জেলাতে যেমন সবাইকে টেক্কা দিয়ে এগিয়েছিলেন কবিতা দাস। রাজ্যেও তেমন স্বীকৃতি মেলায় জেলা পুলিশ মহলেও এখন খুশির হাওয়া। |
|
|
|
|
|