কর্নাটকের রঞ্জি ট্রফি টিম যেমন অবলীলায় এখন মুম্বইকে হারিয়ে দেবে। তেমনই আধুনিক সময়ে যানজটেও দ্রাবিড়ের শহর অনায়াসে হারিয়ে দেবে কুখ্যাত সব ট্র্যাফিক জ্যামের ভাবমূর্তিতে মলিন সচিনের বসতভূমিকে। দিনের যে কোনও সময় শহরের যে কোনও অংশে বেঙ্গালুরুর ট্র্যাফিক আপনাকে আক্রমণ করতে পারে। আর তার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
অথচ আইটিসি গার্ডেনিয়ার ভেতরটা আজ আশ্চর্য রকম ফাঁকা। যেন সিগন্যালটা এখানে কেউ সবুজ করে দিয়ে ঘুমোতে চলে গিয়েছে। অন্য বার আইপিএল নিলামের আগের দিন ভেতরটা গিজগিজ করে। লোকজনে গমগম থাকে। একটা অদৃশ্য ঘোষণাই যেন ব্যাকড্রপে চলতে থাকে যে বিশাল বড়সড় কিছুর আয়োজন হচ্ছে আগামী ক’ঘণ্টায়। তার তো শুধু স্থানীয় বা জাতীয় আবেদন নয়। আন্তর্জাতিক মঞ্চে ব্যাপারটা বিরাট করে ফাটবে।
গত ক’বছরের আইপিএল নিলামের বরাবরের ভেন্যু সেই গার্ডেনিয়ায় মঙ্গলবার দেখা গেল নতুন আবহ। কেউ যেন গোটা এলাকাটায় ‘মিউট’ বাটন টিপে দিয়েছে। তাই ছবি আছে, শব্দ নেই।
একটু আগে হোটেলের ভেতরে ঢুকে গিয়েছেন পঞ্জাব মালকিন এবং অধুনা অনেক তন্বী চেহারায় আবির্ভূত হওয়া প্রীতি জিন্টা। কিন্তু সামনে এতগুলো টিভি ক্যামেরা দেখেও দাঁড়াননি। শিল্পা শেট্টি? দেখা গেল না। শুনলাম না-ও আসতে পারেন। ভিভিএস লক্ষ্মণ দ্রুত সেঁধিয়ে গেলেন লিফটে। কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত! সবে এসে পৌঁছলেন। তিনিও পরিচিত মিডিয়ার লোকজনের দিকে না তাকিয়ে আইপিএল কর্তা সুন্দর রামনকে নিয়ে দ্রুত কফিশপের দিকে অদৃশ্য। সুন্দর যে তথ্যানুসন্ধান কমিটির কাছে মিথ্যে বলেছেন, তা ঘুরিয়ে বলেই দিয়েছে মুকুল মুদগলের রিপোর্ট। সুন্দর হয়তো সে জন্যই বরাবরের রুক্ষ মেজাজটা সঙ্গে নিয়ে ঘুরছেন না। সামনে কিছু বোর্ড কর্তার প্রকাশ্য জটলা। এখন সন্ধে সাতটা। নিলামের আগের দিনের বাধ্যতামূলক ফ্র্যাঞ্চাইজি ব্রিফিং শুরু হবে। বোর্ড কর্তারা তাই নীচে। কিন্তু যতটা পারছেন চোখাচোখি এড়িয়ে যাচ্ছেন। |
যে কোনও সময় মারাত্মক দু’টো বাউন্সার ধেয়ে আসতে পারে। শ্রীনিবাসন কি নিলামের জন্য আসছেন? ধোনিকে কি চাঁই সন্দেহ করে বোর্ড জিজ্ঞাসাবাদ করবে? এরই মধ্যে কেউ খবর আনল কলকাতায় দুপুরে ধোনির কুশপুতুল দাহ হয়েছে। শুনে জমায়েত আরও গম্ভীর হয়ে পড়ল। কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়াবে কেউ বুঝে উঠতে পারছে না।
শ্রীনি সম্ভবত আসছেন না খবর দিলেন তাঁরই ঘনিষ্ঠ এক কর্তা। তার পর বললেন, এলে দ্বিতীয় দিন নিলামের পর আসবেন। বোঝা গেল বিতর্কের আগুন এমন সর্বগ্রাসী জ্বলতে শুরু করেছে যে, অ্যাদ্দিনের অকুতোভয় শ্রীনিবাসনও ছ্যাঁকার ভয় পাচ্ছেন। ঠিক তখনই শ্রীনি-ঘনিষ্ঠ শিবির একেবারে উল্টো কথা বলল। বলল ভয় নয়, এটা স্ট্র্যাটেজি। কেকেআর যেমন বুধবারের নিলামে বিদেশিদের নিয়ে মশগুল না থেকে যথাসম্ভব ভারতীয় প্লেয়ার টানার ছক নিচ্ছে, এটাও তেমনি স্ট্র্যাটেজি। কেকেআরের ছক হল, ওয়ার্নারের আগে সহবাগ। মর্কেলের আগে শামি। টুর্নামেন্ট জেতায় ভারতীয়রা। ওদের আগে টানো। শ্রীনিও তেমনি সবচেয়ে গরম থাকা প্রথম দিন এড়িয়ে যেতে চাইছেন।
তাঁর অনুগত শিবির পরিষ্কার বলছে, দু’তিনটে দিন যেতে দাও। আইপিএল নিলামের বাজারে মিডিয়া হইহল্লা করবে, তার পর যে কে সেই।
এ দিকে, মুকুল মুদগলের দেওয়া বন্ধ খামের ভেতরে সন্দেহভাজনদের অন্যতম হিসেবে ভারত অধিনায়কের নাম রয়েছে কি না, তা নিয়ে দিনভর জল্পনা চলল ক্রিকেটমহলে। প্রভাবিত হয়ে পড়া ক্রিকেট কর্পোরেট জগতের এক বিশিষ্ট মানুষ বললেন, “শুনছিলাম ইদানীং এমএসডি বদলে গেছে। যা রটছে সে সব সত্যি কি না জানি না। তবে ওর এমএসডি-সেভেন ব্র্যান্ডটা কেন দুবাইয়ের ওই রকম নক্কাছক্কা হোটেলে চালু করল, আমার খুব আশ্চর্য লেগেছে। এমএসডি ব্র্যান্ডের ওপেনিং অনুষ্ঠান তো মুম্বইয়ে হওয়া উচিত ছিল। নিদেনপক্ষে দিল্লিতে। দুবাইয়ে কেন?”
খোদ ক্রিকেটমহলের ভেতর এমন সব প্রতিক্রিয়া আর মুদগল রিপোর্ট নিয়ে মিডিয়া কভারেজ। যা দেখলে মনে হবে মহাবিতর্কের দ্বিতীয় দিনেও বুঝি তিরবিদ্ধ থাকলেন শ্রীনি-ধোনি।
ক্রিকেট বোর্ড অলিন্দের হিসেব সম্পূর্ণ ভিন্ন।
তাঁদের মতে দ্বিতীয় দিনটা শ্রীনির। যেখানে খোয়ানো জায়গা অনেকটাই তিনি মেরামত করে নিয়েছেন। স্কোর এখন ১-১।
গত ছত্রিশ ঘণ্টায় ললিত মোদী বাদ দিয়ে ভারতীয় বোর্ড কর্তারা কেউ প্রকাশ্য হননি শ্রীনির বিরুদ্ধে। নিজের মনে, ঘনিষ্ঠমহলে যে যতই ফোঁসফাঁস করুন না কেন, শ্রীনি এমন চাপে থাকা অবস্থাতেও একটা কথা কেউ বিরুদ্ধে বলেননি। পওয়ার না। ডালমিয়া না। বিন্দ্রা না। মনোহর না। মুখ খোলেননি অনুমোদিত রাজ্য সংস্থার যুব কোনও কর্তা। প্রাক্তন ক্রিকেটারদেরও মুখে কুলুপ আঁটা। সে মহাতারকা হন বা অচেনা-অনামী। শ্রীনি-শিবির মনে করে এই যে দ্বিতীয় দিনে কোনও রকম আক্রমণ শানাতে কেউ ভয় পেল, এতে আগুন দ্রুত নিভতে সুবিধে হবে।
দেখাই তো যাচ্ছে বাকিদের মনোভাব কী চিত্ত যেথা ভয়পূর্ণ, নিম্ন যেথা শির।
প্রতিদ্বন্দ্বী বলতে একমাত্র জাতীয় মিডিয়া। তা তাদের শ্রীনি ধর্তব্যের মধ্যে নিচ্ছেন না। ঘনিষ্ঠমহলে নাকি বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টে আসন্ন ৭ মার্চ ঘিরেও তিনি কোনও আশঙ্কায় নেই।
দেখেশুনে সবার মনে হচ্ছে লোকটা নির্ঘাত আবার বেঁচে যাবে। তা হলে আর বিদ্রোহ করে লাভ কী। যেমন প্রতিহিংসাপরায়ণ, বোর্ড থেকেই তাড়িয়ে দেবে। তার চেয়ে চুপ থাকাই ভাল।
ফ্র্যাঞ্চাইজিরা ভেতরে ভেতরে আগুনে হয়ে রয়েছেন। প্রথমত তাঁদের মনে হচ্ছে চেন্নাই সুপার কিংসের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেও তারা এখনও দিব্যি শাস্তিবিহীন, তাতে অন্য যে কোনও টিম হলে কড়া শাস্তি পেত। এটা নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্ব চলছে। দুই, সিএসকে-র যদি শাস্তি হয়, তখন ধোনি-সহ তাদের ধরে রাখা পাঁচ ক্রিকেটার নিয়ে কী করা হবে? তাঁদের নিশ্চয়ই আইপিএলের বাইরে রাখা হবে না। আর যদি তাঁদের নতুন করে নিলামে চড়াতেই হয়, তা হলে একটু অপেক্ষা করা হল না কেন? কেন বুধবারের নিলামটা পিছিয়ে দেওয়া হল না?
আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিলকে এ দিন ফ্র্যাঞ্চাইজিরা খোলা মনে বললেনও নিজেদের নানা বক্তব্য। যেমন নির্বাচনের জন্য আইপিএল যদি ভারতে করতে অসুবিধে হয়, তা হলে যেন সংযুক্ত আরব আমিরশাহির সঙ্গে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ম্যাচ ভাগাভাগি করা হয়। নির্বাচনের সময় ওখানে হল। তার পর বাকি পঞ্চাশ ভাগ এখানে। আমিরশাহি ছাড়া দ্বিতীয় বিকল্প হিসেবে ফ্র্যাঞ্চাইজিরা দক্ষিণ আফ্রিকার নাম দিলেন। অথচ মুদগল কমিটির রিপোর্ট-উদ্ভুত কেলেঙ্কারি নিয়ে সরব হলেন না। সুন্দর রামনকে চেপে ধরে বললেন না, আপনার বা ধোনির এত বড় মিথ্যেতে আইপিএল-ভাবমূর্তির কী সর্বনাশ হচ্ছে, দেখছেন?
সিএসকে কালকের নিলামেও কিছু অন্যায় সুবিধে নিয়ে রেখেছে। প্রথমে তারা বলেছিল, পুরনো ক্রিকেটার দু’জনের বেশি ধরে রাখা যাবে না। সেটা নিজেদের স্বার্থে বাড়িয়ে করেছে পাঁচ। রেখে দিয়েছে ধোনি, অশ্বিন, জাডেজা, রায়না, ব্র্যাভোকে। সঙ্গে রেখেছে একটা জোকার কার্ড। যার অর্থ, মাইক হাসি বা মুরলী বিজয়ের মতো তারা রাখতে ইচ্ছুক এমন কাউকে যদি প্রতিপক্ষ নিলামে কিনেও ফেলে, তারা জোকার কার্ড ফেলে সেই কেনা থামিয়ে দিতে পারে। সমপরিমাণ টাকা খরচে সেই প্লেয়ারকে তুলে নিতে পারে নিজের দিকে। তখন পুরনো টিমের প্রথম ছ’জনই থেকে গেল।
জোকার কার্ডের প্রথম প্রচলনের জন্য অনেকের মনে হচ্ছে এ বারের নিলাম হবে সর্বকালের সবচেয়ে কৌশলী আইপিএল নিলাম। টিমগুলো নিজেরা নকল রিহার্সাল দিচ্ছে। কেকেআর তো নিলাম সংক্রান্ত একটা আইটি কোম্পানির প্যাকেজ চালিয়ে চালিয়ে নেট প্র্যাকটিসের মতো অনুশীলন করেছে। যাতে চাপের মুখে সেরা প্লেয়ার তুলতে পারে।
আর প্লেয়াররা? নিলাম-হোটেলের কয়েক কিলোমিটার দূরে চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে চলছে ইরানি ট্রফি। দুপুরে সেখানে দেখা হয়ে গেল ভারতীয় ক্রিকেটের জেনারেশন ওয়াই-এর সঙ্গে। মণীশ পাণ্ডে আর স্টুয়ার্ট বিনি। মণীশ ভারতের হয়ে খেলেননি। আর সব ‘আনক্যাপড’ প্লেয়ারের সঙ্গে তাঁর নিলাম বৃহস্পতিবার। বিনি ইন্ডিয়া ক্যাপ পরে ফেলেছেন বলে তাঁর ভাগ্য স্থির হবে বুধবার। দু’জনেই খুব উৎসুক ভাবে তাকিয়ে আছেন নিজের নিজের দিনের দিকে। ওঁদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনে হচ্ছিল, এক কালে ভারতীয় ক্রিকেটারের লেবার পেনের সময় হিসেবে চিহ্নিত করা হত সন্ধে ছ’টার এআইআর নিউজ। তখনই টেস্ট দলে নির্বাচিত ভারতীয় ক্রিকেটারদের নাম বলা হত। এখন সেটা বদলে দাঁড়িয়েছে আইপিএল নিলামের দিন। কত টাকা আমার জন্য উঠল?
মুদগল রিপোর্ট বেরিয়ে যা ঘটল, পিটারসেনকে জোকার কার্ড ব্যবহার করে দিল্লি রেখে দেবে কি না। মুম্বই আটকে দেবে কি না মিচেল জনসনকে। কেকেআর ঝাঁপাবে কি না লক্ষ্মী-দিন্দাদের জন্য। এ সব নিয়ে কোনও আলোচনাই নেই। সিএসকে বাদ দিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি মহলে সকলের যেন একই ব্যথা। একটা টিম অন্যায় সুবিধে ভোগ করে যাচ্ছে। কারও সেটা মুখে বলার ক্ষমতা নেই। কর্নাটক ক্রিকেটমহলের এক ব্যক্তিত্ব বলছিলেন, “ওই যেটুকু চাপ মিডিয়া তৈরি করেছে তার জন্য রায়না-টা এশিয়া কাপ থেকে বাদ গেল। নইলে সেটাও হত না।”
আসলে বেঙ্গালুরুতে দু’জনের কেউ না থেকেও শ্রীনি আর ধোনি সেই দুটোই সবথেকে আলোচিত চরিত্র!
|
ভারতীয় তারকাদের নিয়ে হঠাৎ জল্পনা
নিজস্ব প্রতিবেদন
১১ ফেব্রুয়ারি |
মুদগল কমিটির রিপোর্টে উল্লেখ করা ছ’জন ক্রিকেটার কারা তা নিয়ে তীব্র জল্পনা শুরু হয়ে গেল দেশ জুড়ে। মঙ্গলবার আইপিএল মহানিলামের চব্বিশ ঘণ্টা আগে জনমতের এক বৃহত্তর অংশ বলতে শুরু করে দিল, ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগ যাঁদের বিরুদ্ধে, সেই ক্রিকেটারদের নাম বলে দেওয়া হোক, এদের চাঁই কে, জানানো হোক। আবার দেশের ক্রিকেট মহলের বক্তব্য, নির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণাদি হাতে না নিয়ে কোনও ক্রিকেটারের নাম উল্লেখ করা উচিত হবে না। আগে তদন্ত হোক। দোষী বলে কেউ প্রমাণিত হোক। তারপর নাম জানানোর প্রশ্ন। আগে থেকে নাম জানানো হলে বড় সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ দিন দুপুর নাগাদ কয়েকটি ওয়েবসাইট এবং টিভি চ্যানেলে আচমকা মুদগল কমিটির রিপোর্টকে টেনে এনে বলাবলি শুরু হয় যে, আইপিএল গড়াপেটার সঙ্গে যোগাযোগ আছে কয়েক জন ভারতীয় ক্রিকেটারের। কোনও কোনও ওয়েবসাইট, চ্যানেলে আবার মহেন্দ্র সিংহ ধোনি এবং সুরেশ রায়নার নামও তুলে ফেলে। আর পুরোটাই ঘটে মুদগল কমিটির কাছে নাকি জমা পড়া এক পুলিশ অফিসারের রিপোর্টকে কেন্দ্র করে। ত্রিচি রেল পুলিশের এসপি জি সম্পত কুমারের (সিআইডি-তে থাকাকালীন) তদন্ত রিপোর্টে কয়েক জন বুকির কথা বলা আছে। যে বুকিদের মুখে ধোনি এবং রায়নার নাম শোনা গিয়েছে বলে অভিযোগ। রাত পর্যন্ত ব্যাপারটা অভিযোগের পর্যায়ে রয়েছে। রিপোর্টে বুকিদের বক্তব্যের ভিত্তিতে কোনও কিছুই প্রমাণ হয়নি। |