অন্যের দেখাকে তার পাশে দাঁড়িয়ে বুঝে নিতে পারলে তাতে নিজের দেখাটাও অনেক সমৃদ্ধ হয়।
নিজস্বতা আরও বেশি জোর পায়। এই কথাটা মনে না রাখলে পরিণাম ভয়ঙ্কর হতে পারে।
পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায় |
স্পেনে এক দল গবেষক চশমা গোছের এক যন্ত্র বানিয়েছেন। তাঁদের দাবি, এই চশমা পরে এক জন অন্য জনের চোখ দিয়ে দেখতে পারবেন, নিজের শরীরে অন্যকে অনুভব করতে পারবেন। এক জন নারী এবং এক জন পুরুষ, অথবা আলাদা আলাদা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট থেকে উঠে আসা বিভিন্ন মানুষকে নিয়ে পরীক্ষাটি করার ওপরেই বেশি জোর দিয়েছেন গবেষকরা, যাতে দুটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ পরস্পরের দেখার চোখটাকে বুঝতে পারে, আত্মস্থ করতে পারে।
বোঝার তাগিদটা এক দিক থেকে খুব স্বাভাবিক। নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্কটার কথাই ভাবা যেতে পারে। ক্রমশই এক অদ্ভুত অস্বস্তি নিয়ে বাঁচছি আমরা। আমরা, মানে মেয়েরা। আমরা, মানে ছেলেরাও। অন্য জেন্ডারের মুখোমুখি দাঁড়িয়েই ভেতরটা গুড়গুড় করে ওঠে। নিজে মেয়ে হলে প্রতি সেকেন্ডে ভেতর থেকে আওয়াজ, উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষের দৃষ্টিটা কি সত্যিই পরিষ্কার? না কি ওর আড়ালেই ঘাপটি মেরে আছে চকচকে লোভ আর জিঘাংসা মাখানো সেই কুচ্ছিত মনটা, ছিঁড়েখুঁড়ে ধ্বংস করাতেই যার আনন্দ? আর নিজে পুরুষ হলে ফাঁকা কলেজ রুমে, ছুটির টিউটোরিয়ালে, একলা চেম্বারে মেয়েদের জরুরি প্রয়োজনেও পত্রপাঠ ‘না’। যদি একখানাও যৌন হেনস্থার অভিযোগ জমা পড়ে, কে জানে কী ‘মতলব নিয়ে’... দুই তরফের মধ্যে বিশ্বাসের জায়গাটায় আচমকাই যেন এক বিকট বড় শূন্য। কেউ কাউকে পড়তে পারছি না, তার মনটাকে বুঝতে পারছি না। আর বোঝায় এই ফাঁক থেকে যাচ্ছে বলেই সন্দেহটা আরও বেশি করে দানা বাঁধছে। এবং ফাঁকটা কেবল দুই বিপরীত লিঙ্গের মধ্যেই তো নয়, দুই অর্থনৈতিক শ্রেণির মধ্যে, দুই ধর্মে, দুই সংস্কৃতিতে, দুই বিশ্বাসে, এমনকী ভিন্ন ভিন্ন বয়সের মধ্যেও। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই বিস্তর দূরত্ব, আর তার ফলে তৈরি হয় না বোঝা, ভুল বোঝা, অবিশ্বাস, বিবাদ, বিরোধ... |
কিন্তু এখানেই আবার উল্টো দিক থেকেও একটা প্রশ্ন উঠে আসে। একটা সমাজে বাঁচতে গেলে প্রতি দিন আর পাঁচ জনকে যেটুকু জানা বোঝার দরকার হয়, তার চেয়ে অতিরিক্ত কিছুর চেষ্টা করতে যাব কেন? অন্যের ভাবনা, তার দেখার চোখকে নিজের মতো করে বুঝতে চাইলে আমার নিজস্ব ব্যক্তিত্বের হানি হবে না কি? আমি তো আমিই। দিব্যি তো রয়েছি নিজের ভাবনার জগতে। আপন চোখজোড়া দিয়ে পৃথিবীর রঙিন দিকগুলো চেটেপুটে উপভোগ করছি, দাগিয়ে রাখছি কালো স্পটগুলোকে। খামকা সেখানে অন্যকে সাদরে বরণ করে আনার তো প্রয়োজন নেই। বিশেষ করে এমন একটা সময়ে, যখন ‘ইনডিভিজুয়ালিজ্ম’ শব্দটা নাগরিক সভ্যতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গিয়েছে। ‘আমিত্ব’র সঙ্গে নিজের মত, নিজের ধ্যানধারণা এতটাই গভীর ভাবে জড়িয়ে আছে যে, সেখানে পারস্পরিক ভাব-বিনিময়কে বাড়তি গুরুত্ব দিলে কি আত্মবিশ্বাসে আঘাত লাগবে না? আমার মানসিক স্বাধীনতা, স্বাতন্ত্র্য, নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দুর্বল হয়ে পড়বে না? সেটা কি নিজের অপমান নয়?
একটা কথা ভেবে দেখার আছে। আমরা যাকে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বলে দাবি করি, সেটা আসলে কতখানি নিজস্ব? তাকে গড়ে তোলায় তো অনেকের, অনেক কিছুর অনেক অবদান থাকে। আমাদের পারিপার্শ্বিকই আমাদের শেখায়, কোন পরিস্থিতিতে কেমন ভাবে চলা উচিত, কোন পথে চিন্তা করা উচিত, কী ভাবে প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত। সেটা যে কেবল অন্যকে গ্রহণ করার মাধ্যমে গড়ে ওঠে তা নয়, বর্জন করার মধ্যে দিয়েও তৈরি হতে পারে। যিনি নিজেকে প্রচলিত সমস্ত মত এবং রীতিনীতির বিপরীতে প্রতিষ্ঠা করতে চান, তাঁকেও কিন্তু সেই প্রচলিত মত ও রীতিনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে হয়, নয়তো তিনি নিজেকে কীসের বিপরীতে প্রতিষ্ঠা করতে চান, সেটাই স্পষ্ট হবে না। ‘ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য’ খুব দামি। আধুনিক জীবনে খুব জরুরিও। কিন্তু গলার জোরে বা টেবিল চাপড়ে নয়, নিজস্ব মতামত তখনই তার মাটি শক্ত করতে পারে, যখন অন্যদের চোখে সেটা যাচাই হয়ে ফেরে। এতে ‘নিজস্বতা’য় কোনও অপমানের আঁচড় পড়ে না, বরং বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ছানবিন হয়ে এলে আপন তত্ত্বের প্রতিরোধ ক্ষমতা বহু গুণ বাড়ে। এটুকু না করে যিনি সম্পূর্ণ চোখ-কান বুজে নিজের মতের ওপরই অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, সোজা বাংলায় তাঁকে বলে গোঁয়ার। তাঁর অহং-ই তখন তাঁকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। সহজ মেলামেশার রাস্তায় পাঁচিল গেঁথে দেয়। তাঁর নিজস্বতাও ভেতরে ভেতরে দুর্বল হয়েই থাকে।
অর্থনীতি এবং দর্শনের তাত্ত্বিক অ্যাডাম স্মিথ তাঁর ‘দ্য থিয়োরি অব মরাল সেন্টিমেন্টস’ বইতে লিখেছিলেন, ‘আমরা যত ক্ষণ না একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে আমাদের ভাবাবেগ এবং উদ্দেশ্যকে দেখার স্বাভাবিক অবস্থান এবং চেষ্টা থেকে নিজেদের সরিয়ে আনতে পারব, তত ক্ষণ পর্যন্ত কিছুতেই তাদের নিরীক্ষণ করা এবং সেই সংক্রান্ত কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারব না। কিন্তু অন্যের চোখ দিয়ে অথবা অন্যরা যে ভাবে একে দেখবে, সে ভাবে আমরা যদি এদের দেখার চেষ্টা করি, একমাত্র তা হলেই এটা সম্ভব।’ অমর্ত্য সেন স্মিথের বক্তব্যের সূত্র ধরে তাঁর ‘দি আইডিয়া অব জাস্টিস’ বইতে বলছেন, স্মিথের যুক্তিতত্ত্ব শুধুমাত্র অন্যের দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্বের বিষয়টি স্বীকারই করেনি, তার প্রয়োজনীয়তার ওপরেও জোর দিয়েছে। এবং তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, অন্যের চোখ দিয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গিকে যাচাই করার মধ্য দিয়ে একটা উদার বা মুক্ত নিরপেক্ষতা অর্জন করা সম্ভব। তার মানে এই নয় যে আমাকে অন্যের দৃষ্টি দিয়েই দেখতে হবে, ওই ম্যাজিক চশমাটা পরেই থাকতে হবে। আমি কী ভাবব, কী ভাবে চলব, সেটা আমারই সিদ্ধান্ত। কিন্তু অন্যের দেখাটাকে বুঝে নিতে পারলে আমার দেখাটাও অনেক সমৃদ্ধ হতে পারে। আমার নিজস্বতা তাতে অনেক জোরদার হয়।
পৃথিবীটাও হয়তো আর একটু বাসযোগ্য হয়। অন্যকে বোঝার মানসিকতা যদি সত্যিই আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি হত, তা হলে হয়তো সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ‘সহনশীলতা’র ধারণাটা এত তাড়াতাড়ি ফসিল হয়ে যেত না, কুৎসিত মানসিকতাগুলোও দাঁত-নখ বের করে ঝাঁপিয়ে পড়ত না। আমরা স্বাভাবিক ভাবেই বুঝতাম যে, এক জন মানুষের যেমন তাঁর নিজের ভাবনায় বুঁদ হয়ে থাকার অধিকার আছে, বিপরীত লিঙ্গ বা অন্য পরিবেশ, সংস্কৃতি থেকে উঠে আসা মানুষটিরও ঠিক একই অধিকার আছে তাঁর নিজের ভাবনা নিয়ে খুশি থাকার। নিজেকে পালটানোর চেষ্টা না হোক, ‘সহমর্মী’ হয়ে তাঁর দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়াও না হোক, অন্তত এই ‘স্পেস’টুকুর অস্তিত্বকে স্বীকার করতে কোনও অসুবিধে হত না আমাদের। কিন্তু তা না করে প্রত্যেকের নিজের ধারণাকেই একমাত্র ধারণা হিসেবে তুমুল প্রশ্রয় দিয়ে যাওয়া হল। আর তাচ্ছিল্য ছুড়ে দেওয়া হল অন্যের দিকে। ‘অন্য’র এতটুকু অস্বাভাবিকত্বও সহ্য করা গেল না। তাঁর পোশাক, হেয়ার স্টাইল, গায়ের রং, কথা বলার ভঙ্গি, শরীরের গড়নের দিকে ছিটকে এল ঘেন্নার চোখ অথবা লোলুপ চাউনি। ‘অন্য রকম’-এর প্রতি এই অশ্রদ্ধা বা ঘৃণা কোন পর্যায়ে পৌঁছতে পারে, সেটা দেখিয়ে দিল জানুয়ারি-শেষের দিল্লির লাজপতনগর, যেখানে ভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট থেকে উঠে আসা এক পড়ুয়ার চুলের রং আর চেহারাও বিদ্বেষের হাত থেকে পার পায় না। নোংরা মন্তব্য আর তার থেকে তৈরি হওয়া কথা কাটাকাটির জেরে দু’দফায় প্রচণ্ড মারধর থমকে দিতে পারে একটা ঝকঝকে উনিশ বছরের জীবন।
পারস্পরিক সম্মানটুকু অন্তত যাতে হারিয়ে না যায়, তার জন্য স্পেনের গবেষণাগারে তৈরি চশমাটার এক্ষুনি ভীষণ প্রয়োজন। নিদো টানিয়া সেটা জীবন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। |