দীর্ঘ দুই মাস ধরিয়া অনেক টালবাহানার পর নেপালের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হইয়াছেন নেপালি কংগ্রেসের সুশীল কৈরালা। গত নির্বাচনে একক বৃহত্তম দল হইলেও নেপালি কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় নাই। তাই অন্য দলের সমর্থন ব্যতীত তাহার পক্ষে সরকার গড়া সম্ভব হইত না। আর এখানেই দ্বিতীয় বৃহত্তম দল নেপালি কমিউনিস্ট পার্টি (‘সংযুক্ত মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী’)-র সহিত বোঝাপড়া অনিবার্য হইয়া ওঠে। শেষ পর্যন্ত দুই প্রধান দলের আপসেই সুশীল কৈরালা প্রধানমন্ত্রী হইয়াছেন। তিনি যে দুই-তৃতীয়াংশের অধিক জনপ্রতিনিধির সমর্থন পাইয়াছেন, তাহাতেই স্পষ্ট, সাংবিধানিক অচলাবস্থা কাটাইয়া উঠিতে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ কত ব্যগ্র ছিল।
নির্বাচনী ভরাডুবি মাওবাদীদের এই প্রক্রিয়ায় প্রবেশাধিকার দেয় নাই। বিপুল গরিষ্ঠতা লইয়া আগের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হওয়া এই প্রাক্তন বিপ্লবীরা ক্ষমতা হাতে পাইয়াই তাহার যে অপব্যবহার শুরু করেন, যে বিলাসব্যসনের জনবিচ্ছিন্ন জীবনযাপনে অভ্যস্ত হইয়া ওঠেন, জনগণ স্পষ্টতই তাহা ভাল চোখে দেখে নাই। নির্বাচনের ফলাফল মাওবাদীদের প্রাসঙ্গিকতা কাড়িয়া লইয়াছে। তাঁহাদের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও সুশীল কৈরালা প্রধানমন্ত্রী হইলেন। অন্য যে দলটি কৈরালার প্রধানমন্ত্রিত্বের বিরোধিতায় শামিল হয়, সেই রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র পার্টি নেপালে রাজতন্ত্র ও রানাতন্ত্র ফিরাইয়া আনিতে চায়। বলা চলে, নেপালে ইতিহাস একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ করিল। যে রাজতন্ত্রের বিরোধিতা মাওবাদীদের রাজনৈতিক জমি দিয়াছিল, আজ সেই রাজতন্ত্রীদের সহিত হাত মিলাইয়াই তাঁহারা নেপালে গণতান্ত্রিক সংবিধান ও শাসনপ্রণালী রচনার কাজে বাধা দিতে তৎপর।
দৈনন্দিন শাসন পরিচালনা ছাড়াও এই সংবিধান প্রণয়নই নূতন প্রধানমন্ত্রীর প্রধান কাজ। আর এ কাজে তাঁহাকে সর্বাধিক সংখ্যক জনপ্রতিনিধির সমর্থন ও সহযোগিতা আদায় করিতে হইবে। কাজটি দুঃসাধ্য, তবে সুশীল কৈরালার ভাবমূর্তি এ কাজে তাঁহার সহায়ক হইতে পারে। এই প্রবীণ নেতা কৈরালা পরিবারের সদস্য হইয়াও অদ্যাবধি কোনও মন্ত্রিত্ব বা অন্য কোনও সরকারি পদ ভোগ করেন নাই। গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামী হিসাবে তাঁহার খ্যাতি আছে। সেই ষাটের দশক হইতেই, রাজা মহেন্দ্রর দ্বারা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অন্তর্ঘাতের সময় হইতেই, তিনি লড়াই করিতেছেন। এ জন্য তাঁহাকে দীর্ঘ কাল নির্বাসনে কাটাইতে হইয়াছে, নেপালে ও ভারতে কারাবাসও করিতে হইয়াছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের তহবিল সংগ্রহ করিতে এক বার তিনি রয়্যাল নেপাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমানও ছিনতাই করেন। ঘটনাবহুল জীবনের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা বা দুর্নীতিপরায়ণতার বিশেষ প্রমাণ নাই। জনমনে তিনি নির্লোভ বলিয়াই পরিচিত। তাই তাঁহার পক্ষে অন্যান্য দলের জনপ্রতিনিধিদের সমর্থন আদায় করা অপেক্ষাকৃত সহজ হইলেও হইতে পারে। সেই সমর্থন না পাইলে তাঁহাকেও অবশ্য প্রজাতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের কাজটি অসমাপ্ত রাখিয়াই মঞ্চ হইতে অবসৃত হইতে হইবে। ১২৫টি জাতিসত্তা, ১২৭টি কথ্য ভাষা এবং ১২০টি রাজনৈতিক দলের দেশ নেপাল সে ক্ষেত্রে পুনরায় অরাজকতা ও মাৎস্যন্যায়ে অধঃপতিত হইবে। তাহার অর্থ মাদক ও আগ্নেয়াস্ত্র চোরাচালান, জেহাদি বিভিন্ন গোষ্ঠীর গতায়াত ও সংযোগরক্ষার অবাধ চারণক্ষেত্রে পরিণত হওয়া। কেবল নেপাল নহে, গোটা উপমহাদেশের নিরাপত্তার পক্ষেই তাহা অভিপ্রেত নয়। |