অভিযুক্ত ‘দুই ভদ্রলোক’ অধরা কেন, প্রশ্ন কোর্টের
বীরভূমের পাড়ুই গ্রামের সাগর ঘোষ হত্যাকাণ্ডের এফআইআরে নাম থাকা প্রথম ‘দুই ভদ্রলোক’কে গ্রেফতার করা যাচ্ছে না কেন, সোমবার সেই প্রশ্ন তুলল কলকাতা হাইকোর্ট। সিআইডি নিছক লোক দেখানো তদন্ত করছে কি না, আদালত এ দিন সে সম্পর্কেও সংশয় প্রকাশ করেছে। সিআইডি’র তদন্তকারী অফিসারের উপরে অনাস্থা প্রকাশ করে হাইকোর্ট অবিলম্বে তার অপসারণও চেয়েছে।
পাড়ুইয়ের ঘটনার দুই প্রত্যক্ষদর্শী, অর্থাৎ নিহত সাগর ঘোষের স্ত্রী ও পুত্রবধূর দায়ের করা এফআইআরে প্রথম দু’টি নাম যাঁদের, তাঁরা হলেন বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল ও জেলা পরিষদ সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী। শুধু ওঁরাই নন। গত ২১ জুলাই, বীরভূমে পঞ্চায়েত নির্বাচনের ভোটগ্রহণের আগের দিন যে দু’জন সাগরবাবুকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছিলেন বলে অভিযোগ, সেই সুব্রত রায় ও ভগীরথ ঘোষও কেন ধরা পড়ছেন না, সিআইডি’র কাছে তা জানতে চান বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত। তাঁর প্রশ্ন, এদের ধরা যাচ্ছে না, না ধরা হচ্ছে না?
এবং এ হেন পরিস্থিতিতে বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, সিআইডি-র তদন্তকারী অফিসার মোটেই চাপমুক্ত ভাবে কাজ করতে পারছেন না। তাই তাঁকে অবিলম্বে সরানো দরকার। “জানি না, কোন চাপে এফআইআরে উল্লিখিত লোকজনের অনেককে ধরা হচ্ছে না।” মন্তব্য আদালতের। বস্তুত পাড়ুই-হত্যার সিআইডি তদন্ত পুরোপুরি ‘লোক দেখানো’ ব্যাপারে পর্যবসিত হয়েছে কি না, তা নিয়েও বিচারপতি প্রশ্ন তুলেছেন। পাশাপাশি রাজ্য সরকারের কাছে জানতে চান, বর্তমান তদন্তকারী অফিসারকে সরিয়ে ডিআইজি সিআইডি দময়ন্তী সেনকে তদন্তভার দেওয়া সম্ভব কি না। আগামী কাল, বুধবারের মধ্যে রাজ্যকে তা জানাতে হবে হাইকোর্টের কাছে। প্রসঙ্গত, হাইকোর্টের নির্দেশেই মধ্যমগ্রাম-কাণ্ডের তদন্তভার গিয়েছে দময়ন্তীর হাতে।

শেখ মুস্তফা।

প্রিয় মুখোপাধ্যায়।

জলধর দাস।

জগন্নাথ দাস।
পাড়ুই-মামলায় যাঁদের গ্রেফতার না-করায় সিআইডি এ ভাবে হাইকোর্টের তোপের মুখে পড়ল, তাঁদের মধ্যে অনুব্রতবাবু ও বিকাশবাবু অবশ্য এ দিন নিজের নিজের তল্লাটেই ছিলেন। কোর্টের মন্তব্য শুনে অনুব্রতবাবুর প্রতিক্রিয়া, “আমি তো পালিয়ে বেড়াচ্ছি না!” বিকাশবাবু আরও নির্লিপ্ত। “ঘটনার কিছুই জানি না। রোজ অফিস করছি।” বলেছেন তিনি। অন্য দিকে সাগরবাবুর স্ত্রী সরস্বতীদেবী ও পুত্রবধূ শিবানীদেবীর (ঘটনার দুই প্রত্যক্ষদর্শী) আক্ষেপ, “জেলা পুলিশ নিরপেক্ষ তদন্ত করেনি। এখন দেখছি, সিআইডি-ও করছে না! খুনে জড়িত বড় মাথাগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে! আসল অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা চলছে।” সাগরবাবুর ছেলে হৃদয় ঘোষের দাবি, “বাবার খুনের নিরপেক্ষ তদন্ত চাই।”
স্থানীয় পুলিশের তদন্তে অসন্তুষ্ট হয়েই হাইকোর্ট সাগর-হত্যার তদন্তভার সিআইডি’র হাতে সঁপেছিল। কিন্তু এ যাবৎ সিআইডি-তদন্তের গতি-প্রকৃতিও আদালতকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। গত সোমবারও বিচারপতি দত্ত সিআইডি-কে এ প্রসঙ্গে ভর্ৎসনা করেছিলেন। তাদের আর একটি সুযোগ দিয়ে বলেছিলেন তদন্তের নতুন রিপোর্ট জমা দিতে। নতুন রিপোর্ট তাঁকে সন্তুষ্ট করতে না-পারলে কোনও নিরপেক্ষ সংস্থাকে যে তিনি তদন্তভার দিতে পারেন, আগের দিন সে ইঙ্গিতও দিয়ে রেখেছিলেন বিচারপতি।
এ দিন সিআইডি’র তরফে হাইকোর্টে পাড়ুই-তদন্তের সেই নতুন রিপোর্ট পেশ করা হয়। এবং সেটিও আদালতকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। কী রয়েছে তাতে?
সিআইডি-র রিপোর্টে বলা হয়েছে, এফআইআরে নাম থাকা তৃতীয় ব্যক্তি শেখ মুস্তফাকে তারা সোমবার ভোরে গ্রেফতার করেছে। একই সঙ্গে ধরা হয়েছে এফআইআরের ২৩, ২৪ ও ২৫ নম্বরে নাম থাকা প্রিয় মুখোপাধ্যায়, জগন্নাথ দাস ও জলধর দাসকে। তৃণমূলের স্থানীয় সাত্তোর অঞ্চল সম্পাদক তথা ওই পঞ্চায়েতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী সদস্য শেখ মুস্তফা অবশ্য এ দিন বলেছেন, “আমি হৃদ্রোগী। চক্রান্ত করে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে।” রিপোর্ট দেখে আদালতের কী প্রতিক্রিয়া?
বিচারপতি দত্ত সরকারপক্ষের কাছে জানতে চান, এত দিন সিআইডি কী করছিল? “যাঁদের এত দিন বাদে গ্রেফতার করা হল, তদন্তকারীরা আগে তাঁদের বাড়িতে কি এক বারের জন্যও গিয়েছিলেন?” প্রশ্ন করেন তিনি। এই তদন্ত সিআইডি আদৌ শেষ করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বিচারপতি দত্ত বলেন, এখনই সিআইডি-র তদন্তকারী অফিসারকে সরিয়ে দেওয়া হোক। তাঁর কথায়, “বর্তমান তদন্তকারী অফিসারকে কোনও অবস্থায় এই দায়িত্বে রাখা যায় না।” সরকারপক্ষকে তিনি বলেন, সম্ভব হলে সিআইডি’র ডিআইজি দময়ন্তী সেনকে পাড়ুই-তদন্তের ভার দেওয়া হোক। দময়ন্তীকে পাওয়া না-গেলে একই পদমর্যাদার অন্য কোনও অফিসারকে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। বিচারপতির বক্তব্য: রাজ্যে অনেক দক্ষ ও সৎ অফিসার আছেন, যাঁদের উপরে কোর্টের আস্থা আছে। আস্থা যাতে বজায় থাকে, তাই তিনি তদন্তকারী অফিসারের অপসারণ চাইছেন বলে জানান বিচারপতি দত্ত।
কাল, বুধবার পরবর্তী শুনানি। কোর্টের নির্দেশ, সরকারের তরফে সে দিনই জানাতে হবে, পাড়ুই-কাণ্ডের নতুন তদন্তকারী অফিসার হিসেবে কাকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। ব্যাখ্যা করতে হবে, সাগরবাবুর মৃত্যুকালীন জবানবন্দি নেওয়া হয়নি কেন। কেননা তদন্তে গাফিলতির এই দিকটিও এ দিনের শুনানিতে সামনে এসেছে।
কী রকম? আবেদনকারীদের কৌঁসুলি শীর্ষেন্দু সিংহরায়ের দাবি, জখম সাগরবাবুকে বীরভূম থেকে বর্ধমান হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময়ে তিনি দুই নাতিকে খুনিদের নাম বলেছিলেন। বিচারপতি জানতে চান, সাগরবাবুর মৃত্যুকালীন জবানবন্দি নেই কেন? সরকারপক্ষের যুক্তি, জবানবন্দি দেওয়ার মতো ক্ষমতা তখন সাগরবাবুর ছিল না। যুক্তিটি আদালত মানেনি। বিচারপতি জানান, সাগরবাবু তখন যথেষ্ট সচেতন ছিলেন বলে বর্ধমান হাসপাতালের চিকিৎসকই লিখেছেন। “তবে কেন সাগরবাবুর বয়ান পুলিশ লিপিবদ্ধ করল না?” প্রশ্ন কোর্টের।
কাল তাই এ ব্যাপারটাও সিআইডি’কে খোলসা করতে হবে হাইকোর্টের সামনে। এ দিকে পাড়ুই-হত্যার তদন্ত ঘিরে হাইকোর্ট যে ভাষায় সিআইডি-কে ভর্ৎসনা করেছে, তাকে অস্ত্র করেছে বিরোধীরা। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য মহম্মদ সেলিম এ দিন বলেন, “সরকার নির্লজ্জ ভাবে অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে। মুখ্যমন্ত্রীর সবুজ-সঙ্কেত না-থাকাতেই অনুব্রত-বিকাশকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। হাইকোর্ট কার্যত মুখ্যমন্ত্রীকেই ভর্ৎসনা করেছে।” শাসকদলের কী বক্তব্য?
তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “বিচারাধীন বিষয়। তাই কোনও মন্তব্য করব না।”

পাড়ুই মামলায় কেন ভর্ৎসনা
বন্ধনীতে, পরিবারের লোক ও এলাকাবাসীর দাবি
* আদালতের পর্যবেক্ষণও তা-ই

—নিজস্ব চিত্র।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.