|
|
|
|
মোদীর দরজায় কড়া নাড়ছে আমেরিকা |
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি
১০ ফেব্রুয়ারি |
দীর্ঘ ন’বছর পরে আমেরিকা ও নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে সম্পর্কের বরফ গলতে চলেছে। ওয়াশিংটনের নির্দেশে খুব শীঘ্রই বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীর সঙ্গে বৈঠক করতে চলেছেন এ দেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ন্যান্সি পাওয়েল।
বরফ গলানোর চেষ্টা তলে তলে বেশ কিছু দিন ধরেই চলছিল। গত শুক্রবার দিল্লির মার্কিন দূতাবাসের পক্ষ থেকে ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের কাছে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাতের অনুমতি চাওয়া হয়। কারণ, নিয়ম অনুযায়ী কোনও দেশের সরকারি প্রতিনিধি কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাইলে বিদেশ মন্ত্রকের ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক। পাওয়েল এবং বিদেশ সচিব থাকাকালীন হিলারি ক্লিন্টন যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তখনও তাঁদের বিদেশ মন্ত্রকের অনুমতি নিতে হয়েছিল।
মোদী-পাওয়েল বৈঠকের ছাড়পত্র মিলেছে আজই। ভোটযুদ্ধে রাহুল গাঁধীর সঙ্গে মোদীর যতই বিরোধ থাক বা ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে কংগ্রেসের যতই টক্কর থাক বিজেপি-র সঙ্গে, বিদেশ মন্ত্রক এ বিষয়ে রাজনীতিকে কোনও রকম জায়গা দেয়নি। আর বিদেশ মন্ত্রকের ছাড়পত্র পেয়েই মার্কিন দূতাবাস গুজরাত সরকারকে জানিয়েছে, তারা এই মাসেই বৈঠকটি করতে চাইছে। যদি মোদীর অসুবিধা না হয়, তা হলে ন্যান্সি পাওয়েল ১৫ তারিখ গাঁধীনগরে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছুক। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহেই নির্বাচন কমিশন ভোটের বিজ্ঞপ্তি জারি করে দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। তখন নির্বাচনীবিধি কার্যকর হয়ে যাবে। তার আগেই মোদীর সঙ্গে দেখা করতে চান ন্যান্সি। যে আসন্ন সাক্ষাৎকার সব অর্থেই তাৎপর্যপূর্ণ।
কারণ, মোদীর সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিবাদ সুবিদিত। গোধরা-পরবর্তী সংঘর্ষ হয়েছিল ২০০২ সালে। ২০০৫ সালে আমেরিকা মোদীর ভিসা নাকচ করে। মার্কিন বিদেশ দফতর বারবার বলেছে, তারা মোদীকে ভিসা দিতে তৈরি নয়। এমনকী, তাঁর বিরুদ্ধে গুজরাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও তোলে তারা। এ ব্যাপারে আমেরিকার সঙ্গী হয় ব্রিটেনও। তার পর ৯ বছরে কূটনীতিতে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। আমেরিকা যাতে তাদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করে, সে জন্য প্রচুর আবেদন জমা পড়েছে। অন্য দিকে, চাপ বেড়েছে কূটনৈতিক স্তরেও।
এত দিন মোদীর ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-এর অনুষ্ঠানে জাপান বা ইউরোপের দেশগুলি এলেও আমেরিকার কোনও গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি থাকতেন না। জাপান প্রথম থেকেই মোদীকে নিয়ে কোনও ছুঁৎমার্গ রাখেনি। তাই এ দেশে তাদের সব বেশ লগ্নি গুজরাতে। মোদীর রাজ্যে তারা চুটিয়ে ব্যবসা করছে। কিন্তু ইউরোপ এবং আমেরিকার সংস্থাগুলি সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। আর্থিক মন্দার যুগে যা তাদের অস্বস্তির কারণ। তার পর মোদী যদি সত্যিই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, তা হলে কী হবে, সেটা নিয়েও জল্পনা কম ছিল না। অনেকেই প্রশ্ন তুলছিলেন, সে ক্ষেত্রে কি ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করবে ইউরোপ-আমেরিকা। তা কি আদৌ সম্ভব!
এই পরিস্থিতিতে কিছু দিন আগে ইউরোপীয় দেশের রাষ্ট্রদূতেরা বৈঠক করেন। ইতালি, গ্রিস, জার্মানি, ফ্রান্সের মতো দেশগুলির সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নও সেই বৈঠকে সামিল হয়। তাদের বক্তব্য ছিল, ব্রিটেন এবং আমেরিকাকে বিষয়টি বোঝানো উচিত, যাতে মোদীর ব্যাপারে তারা অবস্থান বদল করে। ইউরোপের রাষ্ট্রদূতদের একটি দল এর পরে ব্রিটেনের সঙ্গে আলোচনা করে। যার ফল, সম্প্রতি গাঁধীনগরে মোদীর সঙ্গে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের বৈঠক। |
|
কর্মীদের মাঝে। গাঁধীনগরে দলের নয়া সদর দফতরের উদ্বোধনী
অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদী ও লালকৃষ্ণ আডবাণী। ছবি: এপি। |
এর পর সমবেত চাপ তৈরি হয় আমেরিকার উপরেও। যদিও মাঝে ভারতের ১৫টি দলের সংসদীয় প্রতিনিধিরা মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেন, মোদীকে নিয়ে অবস্থান বদলাবেন না, কিন্তু কূটনৈতিক স্তরে এবং বিজেপি-র তরফে চাপ বাড়তে থাকে। আমেরিকা সফরের সময়ে দলীয় সভাপতি রাজনাথ সিংহ জানিয়ে আসেন, মোদীকে ভিসা না-দেওয়া অন্যায়। আবার দলের আর এক শীর্ষ নেতা অরুণ জেটলিও বিভিন্ন কূটনৈতিক নেতার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালান। সদ্য বিজেপিতে যোগ দেওয়া রাষ্ট্রপুঞ্জে ভারতের প্রাক্তন প্রতিনিধি হরদীপ পুরীও এ বিষয়ে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন।
সম্প্রতি বিজেপি-র পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে দিল্লিতে মোদীর জনসভায় আসার জন্য ন্যান্সি পাওয়েলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বলা হয়, আমেরিকা ভিসা দিক বা না-দিক, বিজেপি ন্যান্সিকে জনসভায় আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। দিল্লির বিজেপি-র মুখপাত্র বিজেন্দ্র গুপ্ত বলেন, জার্মানি, জাপান, ব্রিটেন, চিন-সহ একশোটা দেশের রাষ্ট্রদূতকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। পাওয়েলের ক্ষেত্রেও একই সৌজন্য দেখানো হয়েছে।
ঘটনা হল, মার্কিন কূটনীতিকরাও ভিতরে ভিতরে বরফ গলাতেই চাইছিলেন। তাঁরা বলছেন, সাম্প্রদায়িকতা বা মানবাধিকারের প্রশ্নে অবস্থান যা-ই হোক না কেন, অন্য কোনও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলানোটা কখনওই আমেরিকার লক্ষ্য নয়। কাজেই ভারতের নির্বাচনে কোন দলের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী কে হবেন, তা নিয়ে তাদের কোনও মতামত থাকতে পারে না।
কিছু দিন আগে এক প্রশ্নের জবাবে পাওয়েল বলেন, “এখনই মোদীর সঙ্গে বৈঠক করার কোনও পরিকল্পনা নেই।” এখন যখন বৈঠকের পথ প্রশস্ত, তখন প্রশ্ন উঠেছে, এ বার কি স্বাভাবিক হবে মোদী-মার্কিন সম্পর্ক? বাইরে মুখে কুলুপ হলেও ভিতরে ভিতরে কিন্তু আশাবাদী দু’পক্ষই। |
|
|
|
|
|